মহানায়কের প্রত্যাবর্তন
(আলো জ্বলে উঠবে মঞ্চজুড়ে। গুনগুন করে গান গাইবেন নিরো ভাই। মাঝখানটায় বসে সিগারেট টানবেন ফিজু ভাই। বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মঞ্চের এ পাশ থেকে ও পাশ বেশ উৎকণ্ঠার
সাথে পায়চারী করবে বাদল। তিন-চারবার
পায়চারী করে বিরক্তির সাথে প্রথম কথা বলবে বাদল)
বাদল ঃ “নাহ্ এই আলতাফকে নিয়ে আর পারি না, আর কতন অপো
করবো ওর জন্য? হুশ জ্ঞান বলে যদি কিছু
থাকতো ওর। এই আমি বলে
রাখছি, সময়জ্ঞান বলে যার সেন্স নাই সে কিচ্ছু করতে পারবে না জীবনে।”
(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবারো পায়চারী শুরু করবে বাদল। মঞ্চের এক পাশ দিয়ে আলতাফের প্রবেশ। বাদলের মুখোমুখি হতেই বাদল দ্রুত পায়ে আলতাফের দিকে এগিয়ে এসে
রাগান্বিতভাবে কথা বলবে)
বাদল- “তুমি মনে হয় শ্বশুর বাড়ি থেকে এলে মহারাজ? তা কি অমৃত্য
দিয়ে আপ্যায়ন করলো শ্বশুরবাড়ির কন্যা, জরুরী মিটিং
জেনেও এক ঘন্টা পর আসছো যে ? ”
আলতাফঃ “ তুমি কিন্তু আমাকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছো। বিয়ে করেছো বলে শ্বশুরবাড়ী ছাড়া আর কোন প্রসঙ্গ মাথায় আসে না, না? কাল আমার
ছাত্রীর পরীা তাই পড়াতে একটুখানি দেরিই হয়েছে না হয়। আর তুমি কিছু না শুনে না জেনে লাহামহীন বলে যাচ্ছো।”
( বাদলের মতোই েেপ নিয়ে একনাগারে বলবে আলতাফ। এবার ফিজু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আলতাফ বলবে)
আলতাফ ঃ “মাফ করবেন ফিজু ভাই,
বাদলের বাড়াবাড়ি খুব বেড়ে গেছে। ওকে নিয়েই মিটিং করেন। এই আমি চললাম।”
(মঞ্চ থেকে আলতাফের বেরিয়ে যাবার চেষ্টায় দু’তিন পা এগুতেই
দ্রুত বাদল আলতাফের সামনে জোর হাত করে দাঁড়াবে। তারপর ফিজু ভাই-নিরো ভাইয়ের বসা চেয়ারের দিকে হাত বাড়াবে বাদল)
বাদল ঃ “গোস্তাগী
মাফ করবেন! সিংহাসন ফাঁকা মহারাজ। দয়াসহ বসে আমাদের কৃতার্থ করুন।”
নিরো ভাইঃ “এই তোরা থামবি?”
(শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়সহ আলতাফ বাদল দু’জনেই মাথা
নোয়াবে। তারপর ফিজু
ভাইকে উদ্দেশ্য করে নিরো ভাই বলবে)
নিরো ভাই ঃ “ফিজু তুমি কি এদের ঝগড়া করতে জরুরী মিটিং ডেকেছো?”
ফিজু ভাই (নম্র কণ্ঠে) ঃ “বাদল চুপ
করো। আলতাফ চুপ করো।”
(গোল করে পাশাপাশি রাখা চারটি চেয়ারে বসবে চারজন। ফিজু ভাই সিগারেটের প্যাকেট খুলে সবাইকে একটা করে দিয়ে লাইটার
এগিয়ে দেবে নিরো ভাইয়ের দিকে)
আলতাফ (হাসতে হাসতে)ঃ “ফিজু ভাই, কোন শুভ সংবাদ মনে হচ্ছে? আজ দেখি সিগারেট কিনেছেন। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আজ কপালে সিগারেট জুটছে। বিড়ি টানতে টানতে মুখটাই পচে গেছে।”
(খুকখুক করে খানিকটা কেশে জোরে সিগারেটে একটা টান দিয়ে নাকেমুখে
ভুরভুর করে ধুয়া ছাড়বে আলতাফ)
বাদল (ফিজু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে )ঃ “গুরু আজ কয়েকদিন পর সিগারেট টানছি। এককাপ চা হলে বেশ জমতো।”
নিরো ভাই ঃ “আহ্ বেকারের আবার সমুদ্র বিলাস। এলাকার সব চায়ের দোকানে ত্রিশ চল্লিশ টাকা করে বাঁকি পরেছে। কারো শোধ দেবার মুরোদ নেই। আবার চা হলে বেশ জমতো।”
(দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়বেন ফিজু ভাই)
ফিজু ভাই ঃ “হ্যাঁ আমরা বোধহয় ভুলেই যাচ্ছি, কিভাবে চা
পান করতে হয়। কি রকম চায়ের
স্বাদ!”
আলতাফঃ “স্যরি ফিজু ভাই। শুভ খবর তাই সিগারেট পেয়ে চায়ের কথা বলছিলাম আর কি।”
নিরো ভাইঃ “হ্যাঁ ফিজু, তোমার শুভ সংবাদের জরুরী মিটিং-এ যে আমরা শুধু বকবকই করে যাচ্ছি। তা খবরটা কি বলো। (হাসতে হাসতে) চাকুরি পেলে নাকি?”
ফিজু ভাই ঃ “চাকুরি? চাকুরি? চাকুরির কথা বলছেন নিরো ভাই? ওসব আগাছাদের প্রাপ্য। ( এবার আরেকটু জোরে বলবেন) কতগুলো দরখাস্ত করেছি নিজেই জানি না। তেতাল্লিশটা ইন্টারভিউ দিলাম সেই আঠারো বছর বয়স থেকে। দু’শ’ টাকা খরচ করে দরখাস্ত করি। পরীার প্রবেশপত্র আসে ঠিকঠাক। বাবার অবশিষ্ট দশ কাঠা জমি বিক্রি করে পাঁচশ টাকা করে খরচ করে
পরীা দিয়ে আসি ঢাকা-চাঁটগাও, সিলেট, খুলনা। অসংখ্য পরীায় এ্যানসার করেছি একশ’ পার্সেন্ট। অপোয় থেকেছি এক যুগ। সোনার কবুতর হয়ে ভুল করেও আসেনি একটি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। তারপরও চাকুরির কথা বলছেন? হা হা হা হা...। ছোটকালে
পুস্তকে পড়েছি, সদা সত্য কথা বলো, ঘুষ দেওয়া নেওয়া হারাম,
ওসব মিথ্যা কথা! চাকুরির বাজার ঘুষ খোরদের দখলে। মামা খালুদের দখলে। টাকার দখলে। যার কোনটাই নাই আমার। আছে শুধু বাবার জীর্ণ আদর্শ। সদা সত্য কথা বলো। হারাম থেকে দুরে থাকো। মানুষের মতন মানুষ হও। কি আশ্চর্য! আমিও গাধার মতন বাবার আদর্শ শুনে- মেনেই কাটিয়ে
দিলাম ত্রিশটা বছর। মানুষ দেখতে
পেলাম না। বাবাকেও
বলতে পারলাম না তার শিা ভুল। আজ সজোরে বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে বাবা তোমার আদর্শ আছে তাই তুমি
মানুষ নও! তোমার টাকা নেই তাই তুমি মানুষ নও!”
( কথা বলার সময় ফিজু ভাইয়ের হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট শেষ হবে। কথাও শেষ হবে। এ পকেট ওপকেট হাতড়িয়ে কয়েকটি টাকা বের করে বাদলকে সিগারেট আনতে
দিয়ে বসে পড়বেন ফিজু ভাই। মঞ্চের আলো
অফ)
...............................................................................
মহানায়কের প্রত্যাবর্তন ২.
(দুই মিনিট পর আলো জ্বলে উঠবে। চেয়ারে যে যার অবস্থানে বসে থাকবে। ফিজু ভাই সিগারেট জ্বালিয়ে আবার কথা শুরু করবেন)
ফিজু ভাইঃ “বন্ধু মহল, আজকের মিটিংয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি”
( নিরো ভাই, বাদল, আলতাফ সবাই একসাথে বলবে)
ঃ “আত্মহত্যা?”
( চারদিকে শুনশান নিরবতা। মাথা নুইয়ে বসে আছেন ফিজু ভাই। নিরো ভাই বাদল আলতাফ একে অপরের দিকে প্রশ্নোবোধক চোখে তাকাবে। কেউ কোন কথা বলবে না।)
ফিজু ভাই ঃ “আজ সিমি আবার আমার বেকারত্ব নিয়ে উপহাস করেছে”
নিরো ভাই ঃ “সিমি কে?”
বাদলঃ “আপনি সব ভুলে যান নিরো ভাই। সিমি ফিজু ভাইয়ের প্রেমিকা। এখন প্রাইমারী মাস্টার সজলের বউ।”
আলতাফঃ “সিমি তো এখন সজল মাস্টারের বউ। ফিজু ভাইয়ের প্রেমিকা নয়। ও বেকারত্ব নিয়ে উপহাস করে? একবার দেখা হোক, আচ্ছা করে
স্মরণ করিয়ে দেবো, দু’ল টাকা যৌতুক দিয়ে সজল মাষ্টারের ঘাড়ে ঝুলে পরেছো। আর ঐ টাকা দিয়েই চাকুরি নিলো সজল। যৌতুক না নেয়া ফিজু ভাইয়ের মহত্ব, ব্যর্থতা
নয়। আর সেটা নিয়েই উপহাস করেও?”
ফিজু ভাইঃ “তোমরা অযথা সিমির দোষ দিচ্ছো কেন? ঘটনা যাই
হোক আমরা তো সত্যিই বেকার। আজ সিমি উপহাস করেছে তো কাল অন্যরা করবে। কাটা ঘায়ে লবন ছিটিয়ে আনন্দ পাবার তৃষ্ণা মানুষের প্রবল। সেখানে একটা সিমির কটুক্তি নগন্য, যেখানে বেকারদের
কীটপতঙ্গের সাথে তুলনা করে কর্মজীবীরা। অথচ এদেশে নীতিনির্ধারকরা এসব ল কোটি কীটপতঙ্গদের সংস্কার কিংবা
সৎকার কোনটারই ব্যবস্থা করেনি। ল কোটি বেকারদের তথা কীটপতঙ্গতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাই
আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
(গভীর চিন্তার জালে আটকে পড়ে তিনজনই সিরিয়াসলি শুনবে।)
ফিজু ভাই ঃ “বন্ধু মহল, যে স্কুল-কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করেছি সে স্কুল কলেজের
শিকরা অবহেলার চোখে দেখে। পেছনের সাড়ির
ছাত্ররা অবহেলার চোখে দেখে। সিমিরা ঘৃণার চোখে তাকায়। রাস্তায় বন্ধুর সাথে দেখা হলে এড়িয়ে চলে। আত্মীয় স্বজনের কথা নাই বললাম, এমনকি আমার
বাবা যে আমাকে আদর্শ ছাড়া দিতে পারেনি আর কোনকিছুই সেও কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেয় যে
আমি বেকার। ওদের কথা
বলা, তাকানোর ভঙ্গি বার বার আমাকে চিৎকার করে বলে, ফিজু মেরুদন্ডহীন
চিংড়ি মাছ কিংবা সাদা রক্তের টিকটিকি হয়ে বেঁচে থাকার দরকার নাই। প্রতিটি সেকেন্ড তোমার জন্য কলঙ্ক। তারচে’ আকাশের তারা হয়ে যাও। (কান্নার ভাব চলে আসবে ফিজু ভাইয়ের কণ্ঠে) বেকারত্বের জ্বালা
সম্পর্কে আর নতুন করে কিছু বলার নাই। তাই আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করার। তবে আত্মহত্যার মাধ্যমে আমার শেষ স্বপ্নগুলো পুরণ করতে চাই। রাত হয়েছে তোমরা বরং আজ বাড়ি যাও। কাল যথাসময়ে সবার উপস্থিতি কামনা করছি। বিদায় বন্ধু মহল।”
(ফিজু ভাই
মঞ্চ থেকে বিদায় নিবেন। বাদল পায়চারি
করবে দুঃখভরাক্রান্ত মনে।)
আলতাফঃ “আত্মহত্যার পর আবার স্বপ্ন পূরণ কেমন?”
নিরো ভাইঃ “নতুন কোন ভীমরতি হয়তো! এনিওয়ে, চলো সবাই। কাল দেখা হবে।”
(মঞ্চ থেকে সবার বিদায়। আলো বন্ধ)
.............................................................................
মহানায়কের প্রত্যাবর্তন ৩.
( আলো জ্বলে উঠবে মঞ্চে। নিরো ভাই , আলতাফ, বাদল সবাই চেয়ারে বসে গুন গুন করে কি সব বলাবলি করবে। ফিজু ভাইয়ের আগমন। সবাই উঠে দাঁড়াবে। ফিজু ভাইয়ের সাথে সবাই বসবে।)
ফিজু ভাই ঃ “বন্ধুমহল সময় খুব কম। বেশি কথা বলতে চাই না। আজ আমি আমার
মৃত্যুর রোডম্যাপ ঘোষণা করছি। আত্মহত্যার দিন তারিখ পাকা করে ফেললাম। আগামী ২৩ মার্চ আমার জন্মদিন। আমি চাই জন্মদিনই হোক আমার মৃত্যু দিবস। তাছাড়া সরকারী চাকুরিতে যোগ দেবার বয়সসীমা শেষ হবে ২৩ মার্চ। আর সময় দিতে চাই না আমাকে।”
(শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছবে বাদল। আলতাফ নিরো ভাইও নির্বাক।)
ফিজু ভাই ঃ “তোমরা যে যা পারো টাকা যোগাড় করো। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের ঢাকা যেতে হবে।”
বাদলঃ “গুরু ঢাকা কেন?”
ফিজু ভাইঃ “আমি সুইসাইড করবো ঢাকায়। সুইসাইডের আগে দেশের সব মিডিয়াকে জানাতে হবে। জানাতে হবে সচিবালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। জানাতে হবে ধনী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের। সারা দেশের সারা বিশ্বের বেকারদের জানাতে চাই বেকারত্বের অভিশাপ
নিয়ে সুইসাইড করছি। কয়েকটি প্রিন্ট
ও ইলেকটনিক্স মিডিয়ার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। দু’জন টিভি সাংবাদিকের সাথে কথাও হয়েছে। তারা আমার সুইসাইড সারা বিশ্বকে লাইভ দেখাবে।”
নিরো ভাইঃ “হা হা হা হা....”
বাদলঃ “গুরু আপনি তো তাহলে মহানায়ক হয়ে যাচ্ছেন। সহযোগী নায়ক হিসেবে আমরা অবশ্যই আপনার সাথে আছি।”
(আলতাফও হাঁ সূচক মাথা নাড়বে। সিগারেট জ্বালাবে ফিজু ভাই।)
ফিজু ভাই ঃ “ছোট কাল থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল এক সময় জীবন্ত কিংবদন্তী হবো। পারলাম না। বড্ড আশা ছিল আকাশটাকে দু’হাতে স্পর্শ করার। পারিনি। বাবার আদর্শ বনাম বেকারত্বের মায়া আমাকে মাটিতে হাঁটতেও অযোগ্য
করেছে। আহ! (দীর্ঘশ্বাস
ফেলবে ফিজু ভাই) যা হোক আমার সুইসাইড রোডম্যাপে নিরো ভাইয়েরও গ্রেট হবার সুযোগ রাখছি। (নড়েচড়ে বসলেন নিরো ভাই। )
নিরো ভাই ঃ “কি রকম?”
ফিজু ভাই ঃ “আমার সমাধিস্থলে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে যার নাম হবে
‘জাতীয় বেকার সৌধ’। আমি চাই বেকার সৌধের ভাষ্কর হোন নিরো ভাই। আমরা সারাদেশের বেকারদের প থেকে ধনী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের
থেকে বেকার সৌধের নির্মাণ খরচ দাবি করবো।”
নিরো ভাইঃ “তাহলে কয়েক বছর পর বিভিন্ন চাকুরির পরীায় প্রশ্ন আসতে পারে বেকার
সৌধের নির্মাতা কে? উত্তর হবে , নিরো ভাই। ভাবতেও ভাল লাগছে। অবশ্যই তোমার সাথে আছি ফিজু। সময় বেশি নাই দ্রুত সব কাজ শেষ করতে হবে।”
আলতাফঃ “ফিজু ভাই আপনার সমাধিস্থল কোথায় হবে?”
( আলতাফের কথা শেষ না হতেই উচ্চস্বরে কি এক আন্দোলনের আলোচনা করতে
করতে তিনটে মেয়ের মঞ্চে প্রবেশ করবে। তুমুল আন্দোলনের কথা বলবে। মিনিট খানেক পর মঞ্চের অন্যপাশ দিয়ে বিদায় নেবে)
ফিজু ভাই ঃ “এই সমস্ত সন্ধ্যায় বাড়ন্ত ডানার তরুণীগুলো কে রে বাদল?”
বাদলঃ “প্রফেসর পাড়ার মেয়ে গুরু। ইডেনে পড়ে।”
ফিজু ভাইঃ “ইডেন? আন্দোলন? ইডেন? যৌবনার বাড়ন্ত ডানায় আন্দোলনের পালক! এই তো, এইতো আমি
এদেরই চাই! আন্দোলন চাই। সংগ্রাম
চাই। স্বাধীনতা চাই। হা হা হা হা”
আলতাফঃ “ফিজু ভাই কোথায় হবে আপনার সমাধিস্থল?”
ফিজু ভাইঃ “আজিমপুরে।”
বাদলঃ “গুরু সমাধিস্থলটা আজিমপুর গোরস্থানের চেয়ে বরং রমনা পার্কেই
করা ভাল হবে।”
(বোকার মতন হাঁ সূচক মাথা নাড়বে আলতাফ। কোন ভাবোদয় ছাড়াই এদিক ওদিক তাকাবে নিরো ভাই। নেপথ্যে থেকে অস্পষ্ট শোনা যাবে মেয়েগুলোর হাল্কা কণ্ঠস্বর, ওখানে আন্দোলনেরই
সব কথা থাকবে।)
ফিজু ভাই ঃ “আমার সমাধিস্থল
হবে ইডেন প্রাঙ্গনে। (সবাই একযোগে
তাকাবে ফিজু ভাইয়ের দিকে) ইডেনে সব প্রতিবাদী মেয়েরা পড়ে। ওদের মাঝেই থাকতে চাই হাজার হাজার বছর। তাছাড়া ইডেনে পড়–য়া মেয়েদের প্রেমিকরাও বেকার। বেকারত্বের জ্বালা কেমন তা বোঝে ইডেনের মেয়েরা। নিশ্চয় ওরা বেকারদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। জীবিত অবস্থায় একটা সুস্পষ্ট প্রেমিকা জোটেনি কপালে। তাই মৃত্যুর পর হাজারো প্রতিবাদী মেয়ের পাশে থাকতে চাই। যাতে আমার সৌধটাকে তারা প্রতিদিন দেখতে পারে। জানাতে পারে সংগ্রামী সালাম। বেকার সৌধে খোদাই করে লিখা থাকবে আমার আত্মহত্যার কারণ, এ বছর ২৩
মার্চ জন্মেনি এখন একটি মেয়েও যে কিনা বড় হয়ে ইডেনে পড়লে জানতে পারবে আমার মহান সুইসাইড
তত্ত্ব। এই মহান
আত্মত্যাগে শত বছর পরেও নতুন নতুন একটি মেয়ে বলে উঠবে, ফিজু ভাই
দি গ্রেট। মুক্ত কণ্ঠে
জানাবে সালাম। ২৩ মার্চ
লাল গোলাপ দেবে সৌধে। এই আমার
স্বার্থকতা। এনিওয়ে, আজকের মতো
এ পর্যন্তই সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে রইলো। মৃত্যুর আগে আমার কিছু কাজ শেষ করতে হবে। দেখা হবে ৩ মার্চ। বিদায় বন্ধুরা। বিদায়।”
(মঞ্চ থেকে ফিজু ভাইয়ের বিদায়। মঞ্চের কোন এক কোনে বসে কাঁদবে বাদল। বাদলের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছে দিবে আলতাফ।)
নিরো ভাইঃ “এই বাদল কাঁদছিস কেন বোকার মতোন? তোর কি মনে
হয় সত্যি সত্যি ফিজু আত্মহত্যা করবে?” (আরো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে বাদল।)
আলতাফঃ “আপনার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না নিরো ভাই? আপনি কি
জানেন না ফিজু ভাইয়ের পূর্বের সব ইতিহাস? কথিত স্বাধীন এই দেশটাকে দেখবেন বলে চৌত্রিশ জেলা ঘুরেছেন ফিজু
ভাই। স্মাগলারদের সাথে ভারতে গিয়ে
স্বপ্নদেবীকে দেখবেন বলে চার দিন দাঁড়িয়ে ছিলো সুচিত্রা সেনের বাড়ির সামনে। ফিজু ভাই কখনো মিথ্যা বলেন না। ফিজু ভাই মিথ্যা বলতে পারেন না। যারা মিথ্যা বলে তারা কখনো গ্রেট হবার স্বপ্ন দেখতে পারে না।”
নিরো ভাইঃ “যা হোক আজ আর তর্ক করতে চাই না। ফিজুর সুইসাইড প্ল্যান পছন্দ হয়েছে। আমি ভাস্কর হবো তাই আছি তোমাদের সাথে।”
বাদলঃ “আপনি বড্ড স্বার্থপর নিরো ভাই। কয়েক বছর আগে মাস্টার্স শেষ করেছেন। পেয়েছেন কোন চাকরি? রাষ্ট্র কি দিয়েছে আপনাকে? কি দিয়েছে আমাকে? আজ যখন আত্মত্যাগের
মাধ্যমে ফিজু ভাই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছেন তাদের বোধ বিচার শক্তির
অবয়ের কথা আর তখন কিনা আপনি...। হে রাষ্ট্র, হে প্রজাতন্ত্র তোমার তন্ত্র মন্ত্র জাল থেকে আমাদের রা করো। আর ফিজু ভাইদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিওনা। আমাদের ঠেলে দিও না ফেন্সিডিল, হেরোইনের
দিকে। হে রাষ্ট্র, হে প্রজাতন্ত্র....।”
( শেষ কথাগুলো বাদল উচ্চস্বরে বলতে থাকবে। আলতাফ, নিরোভাই বাদলকে নিয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নেবে)
.........................................................................
মহানায়কের প্রত্যাবর্তন ৪.
(চারজনই মঞ্চে হাজির হবে।)
নিরো ভাইঃ “সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, কয়েকটি রাষ্ট্রদূত এবং ইডেন
কলেজ কর্তৃপরে কাছে পাঠানোর জন্য চিঠি রেডি করে এনেছি।”
আলতাফঃ “কাকে কি লিখেছেন?”
নিরো ভাইঃ “সচিবালয় ও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি- সারা দেশের বেকারদের কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থার দাবীসহ ফিজুর আত্মহত্যার সুস্পষ্ট কারণ। রাষ্ট্রদূতদের থেকে সম্মিলিত ভাবে ত্রিশ হাজার ডলার চেয়েছি ভাষ্কর
নির্মাণ বাবদ। ইডেন কর্তৃপরে
কাছে ক্যাম্পাসে তিন শতক জায়গা দাবী করেছি বিশেষ ভাবে। আশা করছি উনারা বিষয়গুলো সুদৃষ্টিতে দেখবেন। বাদল কালই চিঠিগলো পোষ্ট করে দিও।”
(বাদলের দিকে চিঠিগুলো এগিয়ে দিয়ে নিরো ভাই বলবেন)
বাদলঃ “পোষ্ট করবো, এখন সরাসরি কাজ করতে হবে। ২৩ তারিখে সুইসাইড করলে ১৫ তারিখের দিকে আমাদের সবার ঢাকা যাওয়া
প্রয়োজন। যোগাযোগ
করতে হবে সবার সাথে।”
ফিজু ভাইঃ “বন্ধুমহল তোমরা আমার জন্য অনেক কিছু করছো। আমি তোমাদের প্রতি বিশেষভাবে
কৃতজ্ঞ। আশা করছি
সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলবে। আমি ১৫ তারিখ
পর্যন্ত একা থাকতে চাই। একান্ত সময়
কাটতে চাই। শেষ বারের
মতো এটুকু সময় দিতে চাই আমাকে। তোমরা এ ক’দিন রেডি হয়ে নাও। ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় সবাই এখানে এসো। সেদিন ঢাকা যাবো। আজ তাহলে যাওয়া যাক। বাদল চিঠিগুলো রেজিষ্ট্রি করো।”
(মঞ্চ থেকে সবাই বিদায় নেবে।
তারপর ফিজু ভাই একা মঞ্চে প্রবেশ করবে। সিগারেট জ্বালিয়ে মঞ্চের এ পাশ থেকে ও পাশ পায়চারী করবে। নেপথ্যে থেকে কণ্ঠ আসবে।)
নৈপথ্য কণ্ঠঃ “পাঁচদিন সময় বাঁকী হাতে। কি করতে যাচ্ছি আমি?
কোথায় যাচ্ছি?
হাঁ হাঁ স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছি আমার। মহানায়ক হতে যাচ্ছি। ইতিহাসের মহানায়ক। কিন্তু একি! বুকের মাঝে এতোটা জোরে ধক ধক করছে কেন? ভয় লাগছে
কেন আমার? আমি কি অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলছি? আমার শৈশবের
ধুলামাখা সড়ক, কৈশরের বিপ্লবী চেতনা,
যৌবনের সিমি,
ত্রিশ বছরের বাবা মা, ছোট ভাইয়ের
ইঞ্জিনিয়ার স্বপ্নে আমার দায়িত্ববোধ? না না না। আর ভাবতে পারছি না আমি। উঁচুকে ভেঙেই উঁচুত্তর হতে হয়, মহৎকে ভেঙে
মহত্তর। যার খুব
বেশি অতীত আছে সে কখনো গ্রেট হতে পারে না। গ্রেট আমাকে হতেই হবে। হতেই হবে। তাছাড়া এক মা বাবার সন্তান, এক ভাইয়ের ভাই, এক সাবেক
প্রেমিকার প্রেমিক এই আমার আত্মত্যাগেই বদলে যেতে পারে এ দেশের ল কোটি বেকারের যাতনার
দায়ভার।
(দেড় মিনিট
পর)
না না ভুল করছি আমি। বড্ড ভুল
করছি আমি। গণতন্ত্রের
নামে গণতন্ত্রের ধারক বাহকদের লুটেপুটে খাওয়া এদেশে এক জন ফিজুর আত্মহত্যা কোনই প্রভাব
ফেলবে না। হা হা করে হেঁসে
উঠবে ওরা, যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমার সুইসাইড প্রজেক্ট। ল বেকার হা হুতাশ করবে সত্য, কিন্তু নিদারুণ বয়ে চলা নৈমন্তিক
জীবনের কিছুই পাল্টাবে না তাদের। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যাবেনা তেমনি যুচ্চোর নীতি নির্ধারকদের
নীতি পাল্টাবে না। বরং আন্দোলনে
নামতে হবে। জীবন দৌড়ের
তাগিদেই ল বেকারের দু হাত রাজপথের ধারে গজে ওঠা অট্টালিকাগুলোর দিকে উচিয়ে ধরতে হবে। ল বেকারের বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে, যুচ্চুরি
বন্ধ করো, দুর্নীতি বন্ধ করো, স্বাধীনতা চাই, সেই ১৯ একাত্তরের স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আত্মহত্যা সমাধান নয়। আর আন্দোলন? একটা ফিজু হয়ে আমি কি করতে পারি? আহ্বান জানাতে
পারি। উদাত্ত আহ্বান। হে অবহেলার পাত্র বন্ধু সমগ্র, আহ্বান জানাচ্ছি
তোমাদের। দু’হাত বাড়িয়ে
উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি প্রতিবাদে আসো, আন্দোলনে আসো। কর্ম প্রাপ্তির আন্দোলন। হে বেকার সমগ্র জীবনে ফিরে আসো। নেশা নয়। হতাশা নয়। আত্মহত্যা নয়। কর্মে ফিরে আসো। এই আমি চললাম।”
( মঞ্চ থেকে ফিজু ভাই বিদায় নেবে। হাতে একটা করে ব্যাগ নিয়ে নিরো ভাই, বাদল, আলতাফ প্রবেশ
করবে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাবে বাদল। আলতাফ নিরো ভাই এদিক ও দিক খুঁজবে ফিজু ভাইকে)
নিরো ভাইঃ “বড্ড খামখেয়ালী ফিজু। সবাইকে আসতে বলে নিজেই আসতে পারছে না সময় মতো। বাদল ফোন করো তো ফিজুকে।”
(বাদল পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে নাম্বার টিপে ফোন কানে ধরবে, একটু পরে)
বাদলঃ “ওহ সিট! ফিজু ভাইয়ের ফোন বন্ধ।”
নিরো ভাইঃ “ওর বাড়িতে ফোন করো।”
(বাদল আবার ফোন কানে ধরে কি সব বলে জানাবে)
বাদলঃ “বাড়ি থেকে ওর মা বললেন,
তিন চার দিন থেকে ফিজু বাড়িতে নেই। এখন কি হবে?”
(বাদলের ফোন বেজে উঠবে। বাদল সাইডে গিয়ে কি সব বলবে)
বাদলঃ “টিভি সাংবাদিক ফোন করেছেন আমরা কখন আসছি। তোলপাড় শুরু হয়েছে মিডিয়া পাড়ায়, এখন কি হবে?”
(মঞ্চে সিমির আগমন ঘটবে।)
সিমিঃ “বাদল-আলতাফ তোমরা এখানে?
যা হোক অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম তোমাদের। ফিজু কোথায়? এ সব কি শুনছি পাড়ায় পাড়ায়? ফিজু নাকি আত্মহত্যা করছে? কেন?”
আলতাফঃ “এতোদিন পর তাহলে শুনলে তুমি? সজল মাষ্টারকে বিয়ে করে বেশ
সুখেই আছো বুঝি? তোমার জন্যই ফিজু ভাইয়ের এ অবস্থা। আর তুমি কাটা ঘায়ে লবন ছিটাতে এসেছো?”
সিমিঃ “নাহ আর বলো না প্লিজ। আমি ভাবিনি সেদিনের সামান্য ক’টি কথা থেকে
ফিজু আজ এত বড় সিদ্ধান্ত নেবে। আমি অপরাধী আমি দোষী। আমাকে মা করো তোমরা। মা করো ফিজু। তুমি কোথায়? একবার বলে যাও মা করেছো। এতটা কষ্ট বুকে পুষে চলে যেতে চাচ্ছো সবকিছু ছেড়ে অথচ একবারও
আমাকে জানালে না? বিয়ে হয়েছে বলে কি এতটা পর হয়েছি? কখনোই কি
ছিলাম না বন্ধু? কখনোই না? তাহলে এতটা ব্যথা একাকি বুকে পুষে আছো কেন? কিছুটা আমাকে
দাও। কিছুটা ভার আমাকে দাও যদি কখনো
বন্ধু ভেবে থাকো।” ( হু হু করে কাঁদতে থাকবে
সিমি। নেপথ্য থেকে গান বেজে উঠবে-
এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও। আমায় যদি তুমি বন্ধু ভাবো কিছু জ্বালা আমাকে দাও...। আব্দুল জব্বারের গানটি গাইবে নারী কণ্ঠ।
গান শেষ হলে ফিজু তুমি কোথায় ফিজু বলে মঞ্চ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাবে সিমি। নিরো ভাই আলতাফ এদিক ওদিক তাকাবে বার বার। বাদল একের পর ফোন করার চেষ্টা করবে আর বার বার না সূচক মাথা
নড়াবে। কিছুণ পর
তিনজনই কান্ত হয়ে মঞ্চের মাঝখানে গোল হয়ে বসে সিগারেট জ্বালাবে। সবার চোখে মুখে থাকবে আতঙ্কের ছাপ। কিছুণ পর সেলফোনটা বেজে উঠবে বাদলের। বাদল ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠে নিরো ভাই আলতাফকে জানাবে ফিজু ভাই
ফোন করেছে।)
বাদলঃ “হ্যালো হ্যালো হ্যালো ফিজু ভাই কোথায় আপনি? একটা ঐতিহাসিক
ঘটনার প্রত্যাশায় তোলপাড় শুরু হয়েছে দিকে দিকে। কোথায়? আপনি কোথায়?”
(নেপথ্য থেকে ফিজু ভাইয়ের কণ্ঠস্বরঃ “বাদল আমি
স্যরি। সিদ্ধান্তটা
থেকে তোমরা সরে দাঁড়াও। আমি গাজিপুরে
একটা গার্মেন্টসে সুপারভাইজারের কাজ নিয়েছি। ঢাকা আসার জমানো টাকা দিয়ে তোমরা বরং পোল্ট্রি ফার্ম করো। জীবনে ফিরে এসো।”
(রাগে ােভে ফোন রেখে দিবে বাদল। অতি উৎসাহে নিরো ভাই ও আলতাফ এক যোগে বাদলকে প্রশ্ন করবে)
দুই কন্ঠ ঃ “কি বললো ফিজু ভাই?”
(ধীরে ধীরে ওদের দিকে তাকাবে বাদল।)
(মঞ্চের আলো অফ)
সমাপ্ত
অংশু মোস্তাফিজ
তিলকপুর, জয়পুরহাট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন