শনিবার, ১০ মে, ২০১৪

রাষ্ট্রপক্ষ এবং আমার ও পৃথা’র প্রেম ও ভালবাসা


অংশু মোস্তাফিজ

বাংলাদেশে প্রেমিকদের জন্য দুঃসময় চলছে। একজন প্রেমিক হিসেবে এবং অন্যান্য প্রেমিকদের দেখে শুনে বুঝতে পারি, এ সময় প্রেমের সহয়ক নয়। বাংলাদেশ প্রেমিকদের জন্য নিরাপদ নয়, নিরাপদ ভিলেনদের জন্য। ভিলেনরা ফিল্মি স্টাইলে প্রেমিকদের দমন করছে। ভিলেনের ভূমিকায় কখনো রাষ্ট্রপক্ষ, কখনো রাষ্ট্রীয় পক্ষ এবং অন্যান্য পক্ষ/ মহল অবস্থান নিচ্ছে। এখানে প্রেম করার অপরাধে প্রেমিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আবার নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রতিটি অংশে দুর্নীতির নখ প্রেমিকদের জীবনকে করে তুলছে অস্থির। ফলে প্রেমিকরা ক্রমেই প্রেম থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা, কেবল বেঁচে থাকার জন্য এতোটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, তাতে প্রেম করার মত সময় হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটেও এমনটি দেখা যাচ্ছে। এখানে দেশপ্রেমিকদের জীবনযাত্রা অস্থির করে তোলা হয়েছে। কিন্তু কথা বললে, সমালোচনা করলে, ভিন্নমত পোষণ করলে, নায্য দাবী করলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিংবা ভিন্নমত পোষণকারীদের শায়েস্তা করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে ক্ষমতাশালী দল ও তাদের সহযোগী অজস্র সংগঠণ। আর আমরা এগুচ্ছি শাসন-শোষণ শব্দগুলোর মধ্য দিয়ে।
এমতাবস্থায় ভালবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এমনটি প্রয়োজন বলে মনে করি না। আমার এক সূচি বন্ধুর দাবী, ভালবাসতে হলে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিতে হবে। এমনকি শতাধিক নীলপদ্মও যোগাড় করা লাগতে পারে। আমি তার কথায় দ্বিমত পোষণ করে নাতাশার কাছে যাই। নাতাশা এক বালিকা বধূ। বালিকাই বলবো, প্রেমের টানে ঘর করতে বেরিয়েছে পনের বছর বয়সে। যে জন্য নাতাশার কাছে আসা, সেগুলোর পর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় থুতুনি লাগিয়ে দোলাতে দোলাতে সে বললো, ‘আমার খুব ইচ্ছে করে দিনের সবটুকু সময় তোমার সাথে থাকতে। কিন্তু আমার এই সুবর্ণ সময়ের জন্য সপ্তাহ কাল অপেক্ষা করে থাকতে হয়’। জিজ্ঞেস করি, ‘এই ফিল এর নাম কি?’ আহ্লাদ করে নাতাশা বলে, ‘ভালবাসা।’ জিজ্ঞেস করি, ‘কার জন্য?’ সে বলে, ‘ তোমার জন্য ’। তৌফিকের কথা জিজ্ঞেস করি, মন খারাপ করে মাথা থেকে থুতুনি সরিয়ে নেয় সে। বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি সম্বিত ফিরে পাই। লুকোচুরি করে টিকে থাকা এ শহরের গল্প আমি জানি। ভালবাসার জন্য আমার মতোই ভুল মানুষ বাছাই করেছে তৌফিক। নাতাশা নামের এই মেয়েটির নাম ‘নাতাশা’ নয়। তথ্যটা জানিয়েছে তৌফিকই। মাস তিনের আগের এক আড্ডায় ছেলেটির সাথে প্রথম পরিচয়। তার দু’চার দিনের মধ্যেই সে তার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সব জেনেশুনে পরদিন বেলা এগারটার দিকে ফোন করেছে মেয়েটি। তার দাবী তৌফিকের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন তাকে গাঁজা খাওয়াতে হবে। বিষয়টিকে অবাঞ্ছিত মনে হলেও বিভিন্ন কারণে তার অফার ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সত্যি বলতে কোন সুন্দরীর দাবী ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে প্রতিদিনের দাবীকে সাপ্তাহিক পর্যন্ত টেনে নিয়েছি।
মম’র কথা বলতে পারি। এই মেয়েটি রোজ বিকেলে ছাদে দাঁড়ায়। পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলি, সে দেখে, গোল দিতে পারলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। মম’র ছাদ আর আমার ছাদ পাশাপাশি হওয়ায় টপকানোর ব্যাপারটি সহজ হয়েছে। হাইস্কুল থেকে অদ্যবদি চুমুবিনিময় করা প্রেমিকাদের কথা বলতে গেলে, আমি আরো বেশ ক’জনার কথা বলতে পারবো। এ পর্যন্ত এসে মনে হচ্ছে আমি ষন্ডা টাইপের কেউ? ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়। প্রত্যাহিক জীবন বাঁচাতে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি, ভালবাসা আসলেও পাওয়া যায় কি না, আমি খুঁজছি। দেখছি নাতাশা, মম থেকে পৃথা- সবার অবস্থাই এক। এরা প্রেমকেই বলছে ভালবাসা। আমার ভাল লাগে না। তবু যাবার জন্য পৃথার কাছে যাই। স্বচ্ছ জীবন যাপন করে। কিন্তু সে স্বীকার করে নিয়েছে, তার পক্ষে এগিয়ে আসা সম্ভব নয়। সে স্বীকার করে নিয়েছে, মানবিক সব দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে তার পছন্দ। ভালবাসা পছন্দ, কিন্তু কেবল প্রেমকে অধিক গুরুত্ব দেয়া পৃথার কাছে যাবার কারণ সে অন্তত মানবিক দাবীগুলো বুঝতে পারছে।
পৃথাকে বললাম, ‘তোমার ভবিষ্যৎ বলো।’ এক কথায় সে বললো, ‘অন্ধকার।’
চমকে উঠলাম, এই স্বচ্ছল মেয়েটা অন্ধকার দেখছে কেন?
নি¯প্রভ হয়ে বললো, ‘আমি কেবল এখানে নারীমাত্র। বড় হতে চাইলে, পণ্য। আর গতানুগতিকে কূলবধু। মানুষ হিশেবে এই দুটি অপমানের সাথে ‘ধর্ষণ’ নামক একটি ভয় সব সময় তাড়া করে ফিরছে। সবখানে। স্কুল, মাঠ, অফিস, এমনকি স্বামীর ঘরে, এমনকি নিজের ঘরে।’
মে বি সুজান গ্রিফিন নামের এক মহিলার কথাই পড়েছিলাম। যিনি উপলব্ধি করে এমনটি বলেছিলেন, ‘একটা মেয়ে মাঠে যাবে, সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। একটা মেয়ে স্কুল কলেজে যাবে, সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের।’ 
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো ভয় পাচ্ছো কেন?’
‘একমাসের খবরের কাগজে কতগুলো ধর্ষণের খবর থাকে জানো? খবরগুলো পড়েছো কখনো? পৃথা জানতে চাইলো। বললাম, ‘হ্যাঁ আমি জানি।’ পৃথা বলল, ‘এবার আমাকে বলো সভ্যতা কাকে বলে? যে দেশে হাইস্কুলে যাবার পথে এক একটি মেয়েকে মাইক্রোবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতেই থাকে, সে দেশকে সভ্যতার মাপকাঠিতে তুমি কিভাবে বিচার করবে? অসুস্থ্য একটি নতুন বউ শহরে ডাক্তার দেখিয়ে গ্রামে ফেরার পথে যখন গণধর্ষণের শিকার হন, তখন এটাকে কেন ‘অসভ্য’ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করবে না? চার বছরের এক বাচ্চার ধর্ষিতা হবার খবর পড়লাম সেদিন, আমার মনে হলো, শিশুটি কেবল মেয়ে হবার অপরাধে জন্মেই জানলো, তার জন্য আরো অনেক বিভৎসতা অপেক্ষা করছে। এক মাসের খবরের কাগজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ জন নারীর বিভৎস হবার ঘটনা আমি জানি। সেটা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সমাজের সব স্তরের।’
কিছুক্ষণ থেকে পৃথা বললো, ‘আমি যে নারী, আমার ভয় করে? একজন নাগরিক হিসেবে যখন দেখি, কেবলই মনে হয়, আমি যে দেশের নাগরিক, সে দেশ ধর্ষণপ্রবণ। কিন্তু আমি যখন স্কুল কলেজে পড়েছি তখন জাতীয় সঙ্গীতে গেয়েছি, ’আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি..’। অথচ জানো, সোনার বাংলার সাথে জড়িয়ে পরা এই দুঃসহ শব্দগুলোকে আমি প্রতিদিন ঘৃণা করে যাচ্ছি।’ 
মোবাইল ফোনের ব্যালান্স শেষ। কল ব্যাক করে বললাম, ‘পাশের দেশ ইন্ডিয়া স্বীকারই করে নিয়েছে, তারা নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আমরা তো ঐ পর্যায়ে যাইনি। আমিও স্বীকার করছি, এটা অন্যায়। তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পৃথা।’ পৃথা অটল। ‘ক্ষমা আমি করবো না।’ ‘তাহলে ভালবাসো কিভাবে?’ ‘ভালবাসি না’। ‘তাহলে?’ পৃথা বললো, ‘তাহলে প্রেম।’
আমি বললাম, ‘প্ল্যাকার্ডে সভ্যতার সংজ্ঞা লিখে রাস্তায় নামছো না কেন? সেদিন ‘প্রটেস্ট ফ্রম নাইটিনাইন’ বুকে লিখে মশাল হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম, তোমাকে ডেকেছিলাম, তুমি আসো নি কেন?’
পৃথার উত্তর, ‘তোমরা সচেতনভাবে অসভ্যতাকে বরণ করবে, আর তার জন্য আমার স্বচ্ছ জীবন ছেড়ে রাস্তায় নামতে হবে কেন? তোমরা ভাল হতে পারো না?’
আমি বললাম, ‘পারি। কিন্তু কেবলমাত্র ধর্ষণের ভয়েই তুমি ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’ বলতে পারো না। তুমি সাহসী মেয়ে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক। আমি সাহসী। আমার সামনে দাঁড়ানোর ব্যক্তিত্ব অন্তত কোন ধর্ষকের নেই। কিন্তু আমার দূঃখ, মেয়েগুলোকে চার বছর বয়স থেকে প্রতিদিন ধর্ষণের ভয় সামলে নিয়ে ছেলেদের সমমানে আসতে হয়, তারপর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার জন্য রাষ্ট্রের মুখোমুখি হতে হয়। এখানে এসে আমি তোমার সমান। তোমার ভবিষ্যৎ কি?’
সত্যি বলতে পৃথার বাক্যগুলোর মৌলিক দিক ভেবে আমি হতাশ। আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রীগণ আমাদের এক হাইস্কুলের বেতনভোগী শিক্ষকের আঁচড় থেকে ক্লাস সেভেনের ছাত্রীকে রক্ষা করতে না পারায়, একজন নাগরিক হিসেবে আমি হতাশ। একজন আমেরিকান প্রেমিক যত সহজে তার প্রেমিকাকে পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেমিকদের জন্য সেটা ততটা সহজ নয়। প্রেমিকাদের জন্যও সেটা ততটা সহজ নয়। ফলে পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন প্রেম সংক্রান্ত দুর্ঘটনার খবর দেখি। এ জন্য দায়ী আমাদের সমাজ কাঠামো। পুরনো রীতি পাল্টাবার সৎ সাহস না থাকা। নতুনকে স্বাগত না জানাবার মত অজ্ঞতা। পৃথা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার ভবিষ্যৎ কি?’
বললাম, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে চলতি বছর ভাবিনি। একটু সময় ভেবে নিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি। বাই।’
আমার সূচি বন্ধুর সাথে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে দেখা। শুরুতেই বন্ধু বললো, ‘ভালবাসার দুঃসময় চলছে।’ ‘বন্ধু ঘটনা কি? আছো কেমন?’ বন্ধুর মন খারাপ। দুঃসংবাদটি জানালো সে। সম্প্রতি বগুড়ার বেসরকারি ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক থেকে সম্ভবত ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ৭২ জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রত্যককে জড়িমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খবরটি নাম, ছবি, ঠিকানাসহ স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাদের অপরাধ দিনের বেলা পার্কে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা।
আমি বললাম, ‘পুলিশ কাজটা ঠিক করেনি। তাদের কাজ নাগরিকদের প্রেমের নিরাপত্তা বিধান করা, গ্রেপ্তার করা নয়। তারা চোর নয়, তারা প্রেমিক, তারা প্রেমিকা। ভন্ডামোর রাজনীতি চর্চা করে না, তারা প্রেম চর্চা করে। পার্কে দু’চারজন হয়তো অসভ্য হয়, কিন্তু বেশিরভাগই আসে প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্তরসুরী হয়ে, ধর্মপ্রিয় সমাজের থেকে একটু আড়ালে, হয়তো প্রেমই, হয়তো ভালবাসার জন্য। আর বগুড়ার প্রধানতম পত্রিকা এখানে প্রতিক্রিয়তাশীলতার বীজ পরিচর্যা করেছে। তো, বন্ধু তোমার মন খারাপ কেন? তুমি কি জোড়াগুলোর একজন?’ বন্ধু মন খারাপ করে জানালো, ‘জোড়ার একজন আমার প্রেমিকা, ছেলেটা আমি নই।’ বন্ধু অন্যদিকে মুখ ফেরালো। একটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে দিলাম। ‘কামান বয়, এনজয়।’ বন্ধুর সঙ্গে আরেকদিন দেখা হয়েছিল, জানিয়েছে সে এনজয় করছে এবং ভালবাসা খুজছে।
যা কিছু দেখছি, তাতে খুব আশাবাদি মানুষ আমি নই। আমি জানি, সূচি বন্ধুটি ভালবাসা পাবে না। নাগরিকদের ভালমন্দ দেখার এজেন্সি নেয়া রাষ্ট্র চালকরা দেবে না। প্রেমিকাও দেবে না। ঘুরে ফিরে ওর সাথে দেখা হবে কোন এক নাতাশা, এক মম। ঘুরে ফিরেই দেখা হবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কালো বিড়াল, সবুজ হাতি, নীলপরিদের সাথে। আমি জানি না, সে পৃথাকে গ্রহণ করবে নাকি লুফে নেবে? পৃথার সাথে কথা বলা দরকার, ও জানতে চেয়েছে, আমার ভবিষ্যৎ কি? কোন কিছু চিন্তা করার আগে যেটা মাথায়ও আসছে সেই শব্দটি হচ্ছে ‘অন্ধকার’। পৃথাকে কি বলবো?
‘পৃথা, একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুব অস্থিরতা অনুভব করছি। দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর দেশে আমি ও আমার মত এক একজন নাগরিকের জন্য কেবল অপেক্ষা করে আছে হতাশা।
তাছাড়া রাষ্ট্রের ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের যা অবস্থা করছে, তাতে এখানে নাগরিক হিসেবে বাঁচা প্রায় সময়ই অপমানজনক হয়ে ওঠে! ‘তাদের’ নিকৃষ্ট গণতন্ত্রচর্চা প্রতিটি নাগরিককে অস্থির জীবনযাপনে বাধ্য করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্রতায় একদম সুখী হতে পারি না আমি, আর আমরা।’ পৃথাকে আমি বলতে পারি, ‘ আমাদের ভেঙ্গে পড়া সংস্কৃতি নিয়ে আমি শংকিত। বিশাল সংখ্যক রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে দেখায়, বিশাল সংখ্যক প্রশাসক প্রশাসনকে ব্যবসা হিসেবে দেখায় ক্রমেই রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিটি ইট নড়বড়ে হয়ে উঠছে, আর তার মাসুল দিচ্ছি কিছু সুবিধাবাদী ছাড়া অবশিষ্ঠ চৌদ্দ/পনের কোটি মানুষ। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রের সাথে আমার সম্পর্কের জায়গাটি দেখতে গিয়ে মনে হলো সম্পর্কের অবস্থান একেবারেই স্বস্থিকর নয়। রাষ্ট্র তার প্রতিটি অঙ্গকে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণ বানিয়ে, নাগরিকদের বানিয়েছে ক্রেতা। 
সরকারের পরিচালনা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাণের দিকে তাকালে আমরা কিছু অদ্ভুত চিত্র দেখতে পাই। এইসব চিত্রের কথা পৃথাকে বলবো। স্বচ্ছল জীবন ছেড়ে সে যদি একবার সরকার পরিচালিত হাসপাতালে যায়, দেখবে, গ্রাম থেকে আসা এক বৃদ্ধ রোগির সাথে থাকা অশিক্ষিত মহিলাটি রাত তিনটেয় ডিওটিতে থাকা সিস্টারদের রুমের দরজা নক করতে করতে বলছে, ‘আপা তারাতারি আসেন, কখন জানি স্যালাইন শেষ হয়ে ব্যাগে রক্ত উঠছে।’ ভেতর আপা যেটা বলেন, সেটা একজন নাগরিক হিসেবে সহ্য করা পৃথার জন্য অপমানজনক। আমরা রেলওয়ে স্টেশনে যাই। কিছুক্ষণ স্টেশন মাস্টারের সামনে দাঁড়াই, শুনতে পাবো কেউ কেউ বলছেন, যেন জমিদার বসে আছেন! পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, শিক্ষা, সেবা, টেলিফোন, প্রশাসন, , , , ।
পৃথাকে বলবো, ‘জীবন ধারণের উপযোগী পঁচিশ ধরণের কাজ পারি আমি। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে কাজের দাবী নিয়ে আসার যোগ্য নই। কেননা, চাকরির জন্য ঘুষের ভাগাভাগির কথা এখন সংসদে আলোচনা হয়। মন্ত্রী সাহেবরা প্রকাশ্যে জনসভায় বলে ফেলেন, তার দল না করলে চাকরি সম্ভব নয়। আর সাম্রাজ্যবাদের এই সময়ে গড়ে ওঠা প্রাইভেট সেক্টরগুলো নিজেদের কাঠামো তৈরী করেছে রাজত্ব অনুসারে। ফলে প্রতিটি স্তর গড়ে উঠছে কেউ কেউ রাজা এবং অবশিষ্ঠ ভৃত্য হবার মানসিকতা নিয়ে। আমার ভৃত্য হতে ভাল লাগে না। ব্যবসা এবং অন্যান্য কাজে যাই। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি সরকার এবং তাদের পোষ্য সংগঠণগুলোর কান্ডকারখানা। আমার সামনে ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠে ‘লীগ’, ‘দল’, ‘ছাত্র’, ‘যুব’, ‘স্বেচ্ছাসেবক’, ‘শ্রমিক’ ইত্যাদি ইত্যাদি ‘অমঙ্গলজনক’ শব্দ। আজব হয়ে দেখতে থাকি, আমার সমর্থণে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার নিয়ে আমার সাথে যা’চ্ছে তাই করার পাঁয়তারা করছে এবং করছে। তার নিয়ন্ত্রাণাধীন প্রতিষ্ঠাণে আমাকে আসতে বাধ্য করে দুর্নীতি করছে। প্রতিষ্ঠাণের বাইরে আবার তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে ‘লীগ’, ‘দল’, ‘ছাত্র’, ‘যুব’, ‘স্বেচ্ছাসেবক’, ‘শ্রমিক’ ইত্যাদি ইত্যাদি ‘অমঙ্গলজনক’ শব্দ।
নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কাজের ব্যবস্থা করতে না পারায় আমি হতাশ। তোমার মতই প্রতিদিনের খবরাখবরে আমি ভীত ও আতঙ্কিত। কিন্তু খুব দুঃসংবাদপ্রিয়। দুঃসংবাদ পড়ার জন্য আমি প্রতিদিন ২০ পৃষ্টা কাগজ কিনি। কখনো কখনো মনে হয়, এই দেশ থেকে কেটে পড়ি, ককটেল, খুন, সংঘর্ষ, গুলি, হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট, হরিলুট, দুর্নীতি, দুর্নীতি,,, শব্দগুলোর অত্যচারে ক্রমেই কাহিল হয়ে পড়ছি। কেটে পড়তে পারি না, শেকড় টেনে ধরে।
‘পৃথা, এতোসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে বেঁচে থাকার মাঝে আলাদা করে প্রেম পরিচর্যার সময় আমার নেই। আমি যুগযুগ ব্যয় করেছি মেরিলিন মনরো, ঐশ্বর্য রায়, দীপিকা পাডুকন, সুচিত্রা সেন কিংবা সানি লিওন, এমা ওয়াটসনের প্রেমে। তুমিও দিচ্ছো, আমি নিচ্ছি। কিন্তু আমার যে ভালবাসা দরকার। আমি ভালবাসা খুজছি।’
কিন্তু ভালবাসাতে গিয়ে কেবলই দেখি মলিন হয়ে আসা পথশিশুর মুখ। তিন ডিগ্রি তাপমাত্রায় স্টেশনের রাত্রিবাস, ঝড় ভাঙ্গা মানুষের কান্না। ভালবাসতে গিয়ে আক্রোশে ফেটে পরি নিরন্ন মানুষের চালচিত্র দেখে। আমি দিনমান এইসব দেখি এবং ভালবাসতে থাকি। আমার ভালবাসা পৌছে দিই মুশফিকুর রহিম, সালমান খান থেকে অ্যাসাঞ্জ, স্লোডেনকে। শিল্পকলা ও আবিস্কারের নেশায় যার চোখ উষ্ণ ও শীতল হয়, তার জন্য ভালবাসা দিই। কখনো কখনো রাজনীতিবিদদের ভালবেসে চিঠি লিখে আবার ডিলিট করি, নায্য দাবীর জন্য আন্দোলন যে প্রিয় বলে তাকে ভালবাসতে থাকি। মানবাতার ধর্মে যে দিক্ষিত হতে চায়, তাকে এগিয়ে যেতে আমার সবটুকু ভালবাসা সমর্পণ করি।
কিন্তু পৃথা, কেবল সংকট। উপমহাদেশ ব্যাপি। 
এইসব সংকটে আমার ভালবাসা উতলে ওঠে। উপদ্রুত মানবতার জন্য প্রেম শক্তিশালী হয়। নাজরিনে পুড়ে মরা একশ’ এগার ছাইভস্ম শরীর কিংবা রানা প্লাজার ধসে পড়া ইট পাথরের নিচে চ্যাপ্টা হওয়া আত্মাগুলোর প্রতি আমার ভালবাসা পৌছে গেছে। প্রতিটি উপদ্রুত আত্মার জন্য আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। আমি মুহূর্ত্বেই ভালবেসে ফেলি যারা সৃষ্টিশীল ও অসহায়।’
পৃথার কাছে জানতে চাইবো, শ্রেণী বৈষাম্যের এই দুর্দান্ত সময়ে একটি প্রেমের কবিতায় কতটুকুন উর্বরা হবে স্বদেশ ভূমি, কাটফাটা রোদ কমবে কতটুকু চুম্বনে? নায্য বেতনের দাবীতে আশুলিয়ায় লাখ লাখ নারী যখন রাস্তায় নামে, শ্লোগান দেয়, তখন মনে হয় এদের একজন আমার প্রেমিকা, যাকে আমি ভালবাসি। তার শ্লোগানমুখর মুখ আমাকে প্রেমে পড়তে অনুপ্রেরণা দেয়। 
পৃথাকে বলবো, ‘প্রিয় পৃথা, আমি অনেকবার তোমাকে ভালবাসি বলেছি, ভালবাসি লিখেছি, কি এমন পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের, সেই নিরন্ন মুখ, ক্লান্ত যুবকের ঘুমবিমুখ রাত্র। তাকে আহ্বান জানাবো, তোমার স্বচ্ছ জীবন থেকে নেমে আসো, সত্য ও সুন্দরের জন্য ‘আন্দোলন’ ভালবাসো। বিছানার পাশাপাশি ‘প্রটেস্ট ফ্রম নাইনটি নাইন’-এ আমি এলে, তুমিও এসো। না এলে জানিও, কেন আসবে না? ভাল না বাসলে জানিও, কেন বাসবে না?


কোন মন্তব্য নেই: