অংশু মোস্তাফিজ
ঈদের পরে তুর্য ঢাকা শহরে
যে দিন পা রাখলো, সে দিন হরতাল শুরু। বাসের টিকিট কেনার সময়ও সে
জানতো না। অর্ধেক রাস্তায় আসলে ফোন করলো চাচা। ‘তুর্য জানিস কিছু? ‘কি বিষয়ে?’ চাচা উদ্বেগ নিয়ে
বললো, ‘হুট করে তিন দিনের হরতাল ডেকেছে। ভোর থেকেই কার্যকর। তোর
বাস কোথায়?’
‘যমুনা সেতু।’ শব্দটি বলতে বলতে
কাঁধ উঠিয়ে বাইরে তাকাল তুর্য। ঐ যে মাঝখানে জেগে ওঠা কাশচর, কলেজের পিকনিকে
ঐখানে গিয়েছিল সে। ছোট একটি খেয়া, রিমঝিমকে ভালবাসার গুরুত্ব বুঝাতে সবার অগোচরে
তাকে কোল থেকে নামিয়ে বৈঠা ধরেছিল তুর্য। সেদিনের তিনটে ছবি এখনো রয়েছে ফোন মেমোরিতে।
এইসব ঐহিহ্য মূহুুর্ত্বে খেলে গেল মস্তিষ্কে। সাহাব’চা বলেই
চলেছেন।
‘এখন দু’টো চল্লিশ। একটা
কাজ কর, বাস থেকে নেমে পড়। আশেপাশে কোন হোটেল দেখে উঠে পড়। তিন দিন পরেই রওনা দিবি।’
তুর্য বললো, ‘চাচা, দরকার নেই। সকাল
হবার আগে আগে পৌছে যাবো।’
চাচা বললো, ‘দরকার আছে। এই
শোন, সারাদিন হোটেলে বসে থাকবি। টিভি আছে এ রকম রুমে উঠবি। আমি ‘বিকাশ’ করে হোটেল ভাড়া
পৌছে দিচ্ছি।’
তুর্য আবার বললো, ‘ শাহাবচা দরকার
নেই। তুমি আমার জন্য চিন্তা করছো, এটাই ভরসা, পৌঁছে যাবো।’
চাচা এবার সুর নরম করলেন।
অভিভাবকত্ব অধ্যায় শুরু। ‘তুর্য, শোন বাবা, ধর রাস্তা দিয়ে
হেটে যাচ্ছিস, পাশে ফুটপাতও আছে, সে ক্ষেত্রে ফুটপাত দিয়ে যাওয়াই ভাল, তাই না? তোর পেছনে একটা
ট্রাক ছুটে আসছে, ভাল ছেলে বলে তুই হয়তো ভাবছিস, রাস্তায় অনেক
জায়গা আছে, ট্রাক তোকে মারবে না। কিন্তু আমার ভয় করে, ট্রাক ফুটপাত ভেদ করে দোকানঘর
এমনকি বসতবাড়িয়ে ঢুকে পড়ে মানুষ মারে। এমন ঘটনা ঘটতেই আছে। বাংলাদেশে চালক হতে
সিগনাল চেনারও প্রয়োজন হয় না।’ তুর্য চোখ বন্ধ করে শুনে যাচ্ছে। ‘আজকাল হরতালে কি
হয়,
তুই জানিস, আমিও জানি। হরতাল
মানেই সহিংসতা, রিস্ক নেবার কি দরকার? তুই খুবই ভদ্র একটা ছেলে। এবার উঠে পড়। দ্রুত
বাস থেকে নেমে হোটেল বের কর। কি হয় জানিয়ে ফোন দিস। রাখছি।’
রাস্তায় এতোগুলো লোকের কি
হবে, হরতাল আহ্বানকারীরা যে সে চিন্তা করেন না, তুর্য জানে। অন্য চিন্তা
করছে সে। হুট করে হরতাল জেনে রাস্তায় থাকা হাজার হাজার লোক নিশ্চয় তিন দিনের
হোটেলে উঠবে না। হরতালের কথা কাউকে বলার দরকার নেই। যেমন যাচ্ছে, যাক। সকালের আগে
পিকেটাররা রাস্তায় নামবে না। ভাগ্য বশত সুযোগ পেয়ে যায় তুর্য। সেতু পার হয়েই বাস
থামে। এক বুড়ো বমি করে তিন চারজনের গা মাখিয়ে দিয়েছে। ঐ তিন চার জনও বমি করেছে।
ম্যাসাকার অবস্থা। বাস থামিয়ে পরিস্কার পর্ব চলছে। এই সময়ে চাচাকে ফোন করে তুর্য, ‘অবাক ঘটনা ঘটে
গেছে। সুপারভাইজারকে হরতালের খবর বলার সাথে সাথে উনি তা প্রচার করে দিলেন, আর বাসের সবাই
ডিসিশন নিলো, আশেপাশের কোন হোটেলে থাকবে। একটি তিনতলা হোটেলের সামনে বাস দাড়িয়েছে। কয়েকজন
ভাড়া ঠিক করছে। আমারও ভাল হলো। ক্ষুধা লেগেছিল, এখন খাওয়া যাবে। কোন
চিন্তা করো না শাহাব চা, ঘুমিয়ে পড়ো। জেগে ফোন দেবো।’
চাচা বললো, ‘দেখছিস তো, সবাই এখন সচেতন
হয়ে উঠছে। দুর্বৃত্ত বেড়ে গেছে বুঝলি, সচেতন হওয়াই ভাল। তো খেয়ে
টেয়ে ঘুমো। তুর্য, দৃর্বত্ত মানে বোঝ? এরা দেখতে
মানুষের মত, কিন্তু ‘মানুষ’ ও ‘মানবতা’ শব্দের জন্য মারাতœক হুমকি।’
শাহাব চাচার ভয় করলেও
তুর্যর অতটা করেনি। লোকটার সবকিছুতেই উদ্বেগ। ছোটকাল থেকে এমনই দেখে আসছে সে।
শাহাব চাচা অভিভাবক হলেও বয়সে কাছাকাছি হওয়ায় তাদের ফ্রেন্ডশিপ আছে। বিয়ে করে চাচা
একটু বদলে গেছে। বিয়ের আগের দিন বললো, ‘তুর্য শোন, তোর সাথে আমার
সম্পর্ক ঠিক থাকবে কিন্তু যখন তোর চাচীর সামনে থাকবো, তখন চাচা চাচা
ভাব নেব, মানিয়ে নিস।’ শুনে হাসি পেল তুর্যর। সাহাবচা সিগারেট
জ্বালালেন। ‘দেখ ছেলে, প্রফেসর মানুষ। তাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। এমনিতে বয়সে তরুন, ভাবে একটু ভারস্থ
না হলে চলে, বল?’
তুর্য বললো, ঠিক আছে। দেখছি, কিন্তু চাচা, তোমার শালীকে
আমার মনে ধরেছে, তুমি চাচা হওয়ায় আমি হতাশ, এ ক্ষেত্রে কি করবে?’ অভিভাবকের সুর
নিয়ে সাহাব চাচা বললেন, ‘ অন্য কাউকে খুঁজে বের কর, তোর একুশ হলেই
বিয়ে দিয়ে দেব।’
হেসে উঠলো তুর্য। ‘ওহ মাই গড! এভাবে
পা দিচ্ছি না চা’, তুমি তোমার পথ দেখ।’
সাহাব চা’ বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর ভয় করছে?’
‘ভয় বলছো কেন, তাতে আমার
সুবিধেই হয়! গবেষণার ক্ষেত্রও বাড়বে।’ তুর্য বললো।
শাহাব চাচা চোখ ছোট করে
বললেন, ‘সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাস নাকি?’
‘চাইলে দেবে?’
‘ভেবে দেখবো, তোর ডালিংগুলোর
খবর বল’।
‘ডালিংগুলো?’
বাসে ঝাকুনিতে ভাবনা থেকে
সরে এলো তুর্য। যাত্রীদের মধ্যে মুখচাওয়া চাওয়ি। জিজ্ঞাসার কথাবার্তা। ইতোমধ্যে
হরতালের খবর রাষ্ট্র হয়েছে। সেটা বাসের ভেতরও পৌঁছে গেছে। তুর্য অন্যদের আতঙ্ক
দেখতে দেখতে মনে করার চেষ্টা করলো, চাচা আর কি বলেছিল? ডালিংগুলো’ শব্দটায় তুর্যও
কি একটা বলেছিল। সবকিছু এতো দ্রুত বিস্মৃত হয় কেন? ও বিষয়ে আর কিছু
মনে পরছে না। একটা শব্দ মনে পড়ছে, ‘ঝামেলা’, তুর্য বলেছিল, ঝামেলাই আছি।’ সত্যিই সে
ঝামেলায় আছে। মনে হচ্ছে আজকের ঢাকা শহর তার জন্য অমঙ্গল শহর। এর মধ্যে মনে উকি
দিয়ে গেল, এসএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ায় সাহাবচা’ তাকে গিফট হিসেবে সিনেমা
দেখিয়েছিল। ‘এক টিকিটে দুই ছবি।’ চাচার ধারণা, ‘তাড়না না থাকলে, সাফল্য সহজ হয়
না।’
টঙ্গি মোড়ে আকাশ ফর্শা
হয়ে এলো। ট্রায়ারে আগুন জ্বলছে। আগুন নেভানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। শিশির ভেজা সড়কে
পায়ের ছাপ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের টুকরো দেখে বোঝা যায়, এখানে কিছু একটা
হয়েছে। ডান সাইট দিয়ে তড়িৎ বেগে মোড় ঘুরলো বাস। মুহূর্ত্বে তুর্যদের গাড়ির ছাদ
পেড়িয়ে গাজিপুর রোডে পরপর তিনটে ককটেলের বিস্ফোরণ। তুর্য জানালা দিয়ে প্রথম দেখলো, আরেকটি অদ্ভুত!
হাতের কব্জি থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে এসে ওর জানালার নিচে লাফালাফি করেছে স্তুপ স্তুপ
বিভৎস মাংস। দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলা বাস থেকে আর্তনাদের শব্দ শোনা গেলেও মুখগুলো
দেখা গেল না। কাঁচা ধোয়া সব ঢেকে দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরেকটি বাস ধোয়া
পেরিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। আরেকটি আর্তনাদের শব্দ শোনা গেল। তখনো ছ’টা বাজেনি। বাসের
মধ্যে কান্নাকাটি, হুল্লোর শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন
নামিয়ে দিতে। তারা আর রিস্ক নিতে রাজি নয়। বেশিরভাগ বলছে, দেশেশুনে সামনে
এগুবার। এতোদুর থামলে দুর্গতির অন্ত থাকবে না। বিমানবন্দর এলাকায় এসে রাস্তায়
পুলিশের দেখা পাওয়া গেল।
বাস থামিয়ে দিয়ে এবার
হরতাল কার্যকর করলো পুলিশ। সামনে আর যাওয়া যাবে না। তারা জানালো, ‘ব্যাপক সংঘর্ষ
চলছে।’ বাস থেকে নেমে তুর্য অবাক। আশেপাশে কোন গাড়ি নেই। মানুষ নেই বললেই চলে। থমথমে
পরিস্থিতি। ওদের বাস এতোদুর এলো কি করে, ‘সাহসী চালক’, বলে চালককে দেখে
নেবার চেষ্টা করছে সে।
আতঙ্কগ্রস্থ মানুষগুলো কি
করবে ভেবে পাচ্ছে না। মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। সাথে কোন কোন বাচ্চাও।
সামনের দিকে হাটতে শুরু করলো কেউ কেউ। তুর্যও। কিন্তু একি অবস্থা, আগে পিছের শব্দে
পা যেন আর ওঠে না! চেয়ারম্যান বাড়ি এসে মনে হলো আমার নিজস্ব দুটি পা মাটির উপর
পড়ছে না। পা পড়ছে আতঙ্কের উপর। ফ্লাইওভারের নিচে মাঝখানটা থেকে গুলি ও ককটেল
বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। কখনো একটা, কখনো অনেকগুলো একসাথে। সেই সাথে পুলিশের
সাইরেন। ‘গতির’ পা দুটি রাস্তায় রেখে ফুটপাতে বসে পড়লো তুর্য। দৌঁড়াতে থাকা এক বৃদ্ধ চেঁচিয়ে
বললো, ‘এই ছেলে বোকার মত বসে পড়লে কেন, দৌঁড়াও, দৌঁড়াও। হরতাল
শুরুর আগেই তিনজন গেছে। দৌঁড়াও দৌঁড়াও।’ দৌঁড়ে চললো বৃদ্ধ। গুলির
শব্দ এগিয়ে আসছে। শব্দের আগে দৌঁড়ে আসছে আরো কয়েক জন যুবক। এদেরই কেউ কেউ আবার
পেছনে এগিয়ে গিয়ে ককটেল ছুড়ছে। দ্রিম করে কেঁপে উঠছে এলাকা। ততক্ষণে তুর্য দৌঁড়ে
বৃদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে। পর্যটন কর্পোরেশনের সামনে আরেকটা জটলা। এখানে পুলিশ নেই।
বিশাল দুটো ট্রায়ারের উপর পেট্রোল ঢালা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে
মারলো। সেকেন্ডের মধ্যে আগুনের কুন্ডলী তৈরী হলো। তুর্য থেমে গিয়েছিল কিছুক্ষণ
আগেই। বৃদ্ধটি এ পর্যন্ত এসে দাড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘বলো তো, এসব কি তান্ডব
শুরু হলো? এরা পেয়েছে টা কি?’ খুব ক্লান্ত হলেও বৃদ্ধের চোখ থেকে থোকথোক
আক্রোশ বেড়িয়ে আসছে। তুর্য দেখার চেষ্টা করলো, বৃদ্ধের চোখ লাল কি না? না। তার চোখ লাল নয়।
বাচ্চাদের মত সবুজ। ঠিক সবুজও নয়। বাদামী। এতক্ষণে সে লক্ষ্য করলো, বৃদ্ধের গায়ের রং
রেড ইন্ডিয়ানদের মত, চোখ বাদামী। এ চোখ আক্রোশে লাল হলেও সে লাল
বোঝা মুশকিল। অনেকক্ষণ দৌঁড়ে এসে চিৎকার করায় তার বাদামী চোখে পানি চলে এসেছে।
কণ্ঠের তেজও বলে দিচ্ছে সে অসহায় হয়ে পড়েছে। তুর্যের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ আবার
চেচিয়ে উঠলেন, ‘এরা পেয়েছে টা কি?’ তুর্য মাথা নিচু
করলো।
বিকট হর্ণ বাজিয়ে ফায়ার
সার্ভিসের গাড়ি আসছে। সামনে পুলিশের রায়ট কার। তিন চারটে গুলি ছুড়তেই পিকেটাররা
দৌঁড়ে পালালো।
বৃদ্ধ বললেন, ‘এবার চলো।’
ট্রাভেল ব্যাগ দেখে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘গ্রাম থেকে আসলে না কি, কোথায় যাবে?’
তুর্য বললো, ‘বাংলামোটর।’
বৃদ্ধ ধাপ নামিয়ে নিলেন। ‘তুমি যাবে কি করে?’
তুর্য বললো, ‘জানি না।’
আমতলি থেকে গুলি শুরু
হয়েছে। এগলি ওগলি থেকে হুটহাট বেড়িয়ে আসছে ককটেল। এখানকার পুলিশ ফায়ারিং মুডে
অবস্থান নিচ্ছে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার সাথে এসো’।
তিতুমীর কলেজ পার হয়ে এসে
একটা রিকশা পাওয়া গেল। গুলশান মোড়ে ট্রায়ারে পানি ঢালছে পুলিশ। পূর্ব দিকে শ’খানেক লোককে
সামাল দিচ্ছে ডজন খানেক পুলিশ। কাদুনে গ্যাসের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আরো জোরে পা
চালাও। আতঙ্ক ও অভিজ্ঞতায় রিকশাওয়ালা শরীরের সবটুকু শক্তি প্রতি সেকেন্ডে ঢেলে
দিতে থাকলো পেডেলে। এগারটা সাতাশ মিনিটে মধ্য বাড্ডার একটা গলির সামনে রিকশা
থামলো। এদিকের অবস্থা একটু ঠান্ডা। বৃদ্ধও ঠান্ডা হলেন। ট্রাউজারের পকেট থেকে
সিগ্রেট বের করে জ্বালালেন। ‘তুমি সিগারেট টানো?’ তুর্য বললো, ‘হাঁ, টানি’। বৃদ্ধ আরেকটি
সিগারেট বের করতে গেলে তুর্য বললো, ‘কিন্তু আপনার
সামনে টানবো না।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘লজ্জা পাবার কারন
নাই। যে ধকল গেল। টানো, টানো।’ তিনি সিগারেট এগিয়ে
দিলেন। তুর্য বললো, ‘ঝামেলা থেকে বাঁচালেন, সিগারেট না টেনে
তার রিওয়ার্ড দিলাম। আর দেখা নাও হতে পারো। পরে সুযোগ পাবো না।’
বৃদ্ধ কাঁধ ঝোকালেন। ‘হুম্, বুঝেছি’, তো তুমি এখানে কি
করো?’ ‘পড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফিজিক্স। ‘বাড়ি কোথায়?’ ‘রংপুর।’ ‘রংপুর? তুমি রংপুরের
ছেলে? বলো তো, আগে বলবা না? সতের বছর রংপুরে কাটিয়েছি বুঝলে।’
ফোন বেজে ওঠে বৃদ্ধের।
রিসিভ করেই বলেন,‘ হ্যাঁ রে, অল্পের জন্য বেঁচে আসলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাল আছি, চলে এসেছি, গলির মোড়ে। না, না, এখানে নয়, মহাখালী
ফ্লাইওভারের নিচে। হ্যাঁ, দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে, সে কি অবস্থা।
এখনো হাপাচ্ছি বুঝলি। না, না, আমি ভাল আছি, গায়ে লাগেনি, দু’হাত দুরে পরেছিল।
বড় বোমা নয়, ককটেল জাতীয় কিছু। না, কিন্তু আমি বোধহয় কানে একটু কম শুনছি না রে?’
‘কানে কম শুনছো কি না, নিজে বোঝার
চেষ্টা করো, একদম দেরি করো না, এখনি চলে আসো।’ তুর্য হাসছিল।
ফোন রেখেই তাড়াহুরো শুরু করলেন বৃদ্ধ।
বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি দেখেশুনে
যাবার চেষ্টা করো বাবা, আমি যাই, ভালো থেকো।’ তুর্য বললো, ‘আপনিও ভাল
থাকবেন। এই বয়সে হরতালের মধ্যে রাস্তায় বেরুবেন না।’
বৃদ্ধ আরো এক পা এগিয়ে
এসে বললেন, ‘হাসপাতালে ছিলাম বাবা, একদম বুঝিনি। এরা সবাই ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বুঝলে, একদম পায়ের কাছে
পড়েছে, রিকশা থেকে লাফ না দিলে মারা পড়তাম। বেঁচে আসলাম বাবা। এখন কানে বোধহয় কম
শুনছি। তুমি যাও, দেখেশুনে যাও।’
আরেকটি রিকশার খোঁজে
মিনিট চারেক হাটার পর একটা মিছিলের মুখোমুখি হলো তুর্য। ভাংচুর করার মত কোন গাড়ি
না পেয়ে রাস্তার পাশের দোকানপাটে লাঠির আঘাত, লাথি-ঘুষি যে যা পারছে
মারছে। একজন আগুন লাগাবার চেষ্টা করছে গলির মুখে ঢেকে রাখা অটো সিএনজিতে। কোত্থেকে
তিনচারটে পুলিশের গাড়ি এলো। গাড়িগুলো তুর্যকে অতিক্রম করেই গুলি শুরু করলো।
জলকামান স্টার্ট করে দমকলের একটি গাড়ি সামনে দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে
বৃষ্টির মতো ককটেল বিস্ফোরণ শুরু হলো। এইটুকু বুঝেই পেছনের দিকে দৌঁড় দিলো তুর্য।
সেই গলির মুখে যেতেই তুর্য দেখলো, বৃদ্ধও দৌঁড়ে এগিয়ে আসছেন। তুর্যর মুখোমুখি
হতেই হাত ধরে বললেন, ‘এসো’।
তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটা
মেয়ে গেট খুলে দিলো। ওকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হবার পরামর্শ দিয়ে গেলেন
বৃদ্ধ। পকেটা হাতড়িয়ে ফোন বন্ধ পেল সে। সাহাব চা’র মুখ মনে পড়লো।
লোকটি কি’ না চিন্তা করছে। চার্জে লাগিয়ে ফোন করলো তুর্য। ভাল আছিস কি’ না, তুর্যকে জিজ্ঞেস
করেই শোকগ্রস্থ কণ্ঠে সাহাব চাচা আক্রোশে ফেটে পড়লেন। ‘একদম বোকা ছেলে
তুই। একদম বোকা। তোর জন্য আমার কত চিন্তা, এসব বুঝিস? এমনি এমনি বড়ো
হয়েছিস না?’
তুর্য বললো, ‘মামা, এতো চিন্তা করার
কিছু নেই। ঘুম থেকে জাগতে পারিনি, ফোনে চার্জ ছিল না। ঘটনা শেষ। আমি এখন হোটেলের
বেলকনিতে। চিন্তা করো না মামা। আচ্ছা মামা, আমার মামি, মানে তোমার বউও
কি আমার জন্য এমন চিন্তা করে?’
চাচা বললেন,‘ না রে, এমনি তুই কাছে থাকলে
দরদ বেশি দেখায়। কিছু মনে করিস না, হ্যাঁ! আমি তোকে অনেক
ভালবাসি চ্যাপ্টা, তোর আর কার ভালবাসা দরকার বল? তারচেয়ে তুই
প্রেম কর, প্রচুর প্রেম কর।’ এখন আমি খাবো, রাখছি বলে ফোন
রাখলো তুর্য। খেয়াল করে দেখে সে হাসছে। চাচা ওকে বছর দুয়েক পর চ্যাপ্টা বলেছে, সে বলেছে মামা।
ছোলবেলা থেকেই দুজন দুজনকে ইমপ্রেস করার ক্ষেত্রে বিকল্প নাম ব্যবহার করে। হাসি
জোড়ালো হয় তুর্যর, তাই বলে ‘চ্যাপ্টা’?
মেয়েটি এসে জিজ্ঞেস করে, ‘ফ্রেস হয়েছেন
আপনি? বাবা ডাকছে, খাবে।’
তুর্য বলে, ‘না হইনি, এই হয়ে নিচ্ছি।
বাবাকে বলো, আসছি।’ ব্যাগ খুলতে খুলতে তুর্য জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কি? আমার নাম তুর্য।’ ‘সুস্মিতা’, বলে চলে যাচ্ছিলো
সুস্মিতা। তুর্য ডাকলো, ‘শোন, একটু হাসো তো।’
‘উদ্বেগের কিছু নাই, আমার হাসি
এমনিতেই সুন্দর। সবাই বলে। আপনিও বলবেন। কিন্তু এখন হাসতে পারছি না, অল্পের জন্য বাবা
বেঁচে আসছে, তার পায়ের কাছে ককটেল পড়েছিল। শয়তানদের কর্মকান্ড দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে
করছে কেঁদে ফেলি। কাঁদবো? আমি কাঁদলেও সুন্দর লাগে। সবাই বলে। আপনিও
বলবেন।’
হেসে ফেললো তুর্য। মনেমনে
‘আশ্চর্য মেয়ে’ বললো।
সুস্মিতা বললো, ‘আপনি বাবার কে
হোন?’
‘সহগাজী। মানে মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজি এই
সূত্রে।’
ঠোট বাঁকিয়ে, কাঁধ ঝাকিয়ে কোন
কিছু বোঝেনি ভাব করে চলে গেল মেয়েটি। তুর্য বাথরুমে ঢুকবে এ অবস্থায় ফোন বেজে
উঠলো। পাপুল। সে উৎকণ্টা ও আক্রোশ একসাথে জড়িয়ে বললো, ‘সিরাজুল ভাই তোকে
খুঁজে অস্থির। এই সময়ে ফোন বন্ধ করে বসে আছিস না? আরে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার
করা পরম ধর্ম বুঝলি।’
তুর্য ঠান্ডা স্বরে জানতে
চাইলো, ‘কি ঘটনা?’
খেকিয়ে উঠলো পাপুল, ‘পার্টি হরতাল
দিছে। পার্টি মনে করেছিল লাখ লাখ লোক রাস্তায় নামবে। দেখা গেল শ’ শ’, হাজার হাজার।
খালি গাড়ি ভাংলে আর আগুন লাগালে হবে না, রাস্তায় লোক লাগবে। উপড়
থেকে অর্ডার আসছে, সিরাজুল ভাই বলেছে তোকে রাস্তায় নামতে।’
চমকে উঠলো তুর্য। বলে কি
ছেলে! সে জোর দিয়ে বললো, ‘কিন্তু আমি তোদের দলের সদস্য নই।’
এবার ঠান্ডা মাথায় শুরু
করলো পাপুল। মুসলমানদের ইমান রক্ষা মহান দায়িত্ব, একজন ইমানদার
ব্যক্তিকে কুচক্রিদের অপঘাত থেকে রক্ষা করতে যে যুবক শহীদ হবে হাসরের ময়দানে সে
বেহস্তে যাবার মিছিলে নেতৃত্ব দেবে! দোস্ত কি রায় হয়েছে তুই জানিস, এই মুহুর্ত্বে
রাস্তায় না নামলে তোর ইমান থাকবে না। আমার ইমান থাকবে না। তাছাড়া সিরাজুল ভাই তোকে
সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই দাবীতে সে তোকে বন্ধু হিসেবে চাইছে।
পিকেটিং করতে হবে না, সাথে থাকলেই চলবে। না গেলে কিন্তু ভাই রাগ
করবে।
তুর্য বললো, ‘ পাপুল ঠান্ডা হ, এক মিনিট আমি বলি
তুই শোন, বুঝতে পারবি। প্রথমত আমিও একজন ইমানদার ব্যক্তি, দেশের যা খবর
শুনছি তাতে নিজেকে দুর্বত্তদের হাত থেকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। কর্তব্য ফরজে আইন, দায়িত্ব ফরজে
কেফায়া। দেখ রাস্তায় নামা, না নামার ইচ্ছা টোটালি আমার। তাছাড়া আমি ঢাকা
নেই। জানিস তো, আমি গ্রামের বাড়ি এসেছিলাম। কালকেই যাবার কথা ছিল, কিন্তু রায়ের
খবরে বাস লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আ’লীগ নেতার বাসে আসছিলাম, টাঙ্গাইল এসে
আটকা পড়েছি। হোটেলে উঠেছি। সিরাজুল ভাইকে বলিস আমি ঢাকা গিয়ে দেখা করবো। ভাই তোর
কাছে থাকলে ফোন দে’ কথা বলি।’
পাপুল বললো, ভাই সাংগঠনিক
কাজে ময়মনসিংহ আটকা পড়েছে। আচ্ছা, তোর হোটেলের নাম বল।’ তুর্যর মনে হলো, সিরাজুল ভাই
বলেছিলেন, বিয়ে না করলেও তিনি স্বামী, তার শ্বশুরবাড়ি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার
শ্বশুরবাড়ির পাড়ায়। প্রয়োজনে তিনি প্রেম করবার পরামর্শ দিয়েছেন। হেল্প লাগলে বলতেও
বলেছেন। ‘হোটেলের নাম কি তুর্য?’, পাপুল আবার বললো। তুর্য বললো, ‘মধুরিমা’।
বাই বলে স্বস্থি পেল সে।
একটি এসএমএস এসেছে। বিকাশে টাকা। তিন হাজার। তিন হাজার টাকা দেখে মন চলমলিয়ে উঠলো।
পুরোটাই লাভ। সেই সাথে কিছু শব্দ মাথার মধ্যে খেলা করে যাচ্ছে, যা এখনি ফোনালাপে
বলাবলি হয়েছে। যেমন একটি তার দুর্বৃত্ত। এ শব্দের সাথে সাহাব চা’র মুখ মনে পড়লো।
রাতের সে বলছিল। এবার বাথরুমের দরজা খুললো তুর্য। ভেতরে যাওয়া হলো না, পাপুলের ফোন।
‘স্যরি দোস্ত, টাঙ্গাইলে এই
নামের কোন হোটেল নেই। বেইমানী করলি না’, ভাইকে বলছি, মনে কর এই এলাকা
তোর জন্য নিষিদ্ধ হলো।’ ফোন রেখে দিলো সে।
‘ওহ মাই গড!’, বলে বসে পড়লো
তুর্য। এ কি অবস্থা? তাকে মেসে যেতেই হবে। কাপড়চোপড়ের জন্য না হলেও, কাগজগুলোর জন্য।
ছয় বছর আগে, ফার্স্ট ইয়ারে, বিদেশী এক
সায়েন্স ফিকশনে আটকে যায় তুর্য। তার ধারণা, এই ফিকশনকে সে বাস্তবে
দাঁড় করাতে পারবে। আলো নিয়ে গবেষণা শুরু করে সে। প্রতি বছর এগুতে থাকে
সূর্যরশ্মিকে আটকে শক্তি সঞ্চয় করার কাজে। এই সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ঘটিত যাবতীয়
কাজ করা যাবে। তাতে বর্তমানের সোলার সিস্টেমের দশ ভাগের একভাগ খরচা হবে। ছয় বছর
ধরে থিওরি ও প্রাকটিক্যালে এগিয়েছে তুর্য। ওর বয়সী চাচার এই গর্বে ওকে নিয়ে যত
উদ্বেগ। শাহাব চা’র কথা ভাবতেই দায়িত্ববান হয়ে ওঠে তুর্য। সেই দশ
বছর বয়সে বাবাকেও হারালে সমসাময়িক চাচা ওকে এতোদুর নিয়ে এসেছে। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ‘শাহাব চাচা, ইউ আর গ্রেট’, মনে মনে বলে সে।
সুস্মিতা আসে আবার, ‘আপনার এখনো হয়নি? সারাদিন এতো
প্রেম করা লাগবে কেন? সারাদিন কানে ফোন লাগিয়ে থাকা ছেলেদের আমি
দেখতে পারি না। আমার চেয়ে বড়দেরও না।’ সুস্মিতা চলে গেল।
ফোন অফ করলো তুর্য।
ঝামেলা আর ভাললাগছে না। তাকে ফ্রেশ হতে হবে। খেতে হবে। বৃদ্ধ অপেক্ষা করছেন। বৃদ্ধ
শব্দটায় অস্বস্থি হচ্ছে। ভদ্রবৃদ্ধের নাম কি? জেনে নেয়া যাবে। আপাতত
তিনি সুস্মিতার বাবা। বাথরুমে ঢুকলো সে।
বিকেলে আবার এসেছিল
মেয়েটি। ‘বাবা বলেছেন, সারাদিন ঘরে বসে থাকার দরকার নেই। বাইরে যাওয়া
যাবে না, তবে ছাদে যাওয়া যেতে পারে।’ তুর্য বললো, ‘যাবো, তুমি গেলে।’ সুস্মিতা বললো, ‘যাব, গান শুনালে।’ তুর্য বললো, না, আমি গান টান পারি
না,
চলো তোমাকে যাদু
দেখাবো।’ ‘উফ!’ বলে লাফিয়ে উঠলো সুস্মিতা, দু’হাত উপড়ে তুলে
নাচের ভঙ্গিতে দুলছে সে। তুর্য’র হাসি পেল। একবার মনে হলো, বলি, ‘এই পিচ্চি, নাচবে তুমি, কেবল আমার সামনে? আমি হাছন রাজা
হয়ে বসে থাকবো, আর তুমি পেয়ারী হয়ে গাইবে, ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকাদু’নয়নে নেশা লাগিল
রে..’, কিন্তু তুমি যে পিচ্চি! তাতে কি, এই পিচ্চি, নাচবে তুমি? এই সুস্মিতা?’ তুর্য অবাক হয়। এ
সব কি ভাবছি। হাইস্কুলের আরেক পিচ্চি মস্তিষ্কে ঘুরে যায়। ‘আমার কি অতটা
ভালবাসা দরকার? তাহলে প্রমিকে বলছি না কেন, ও তো বলেছে, ‘সব দেবে।
ভালবাসার জন্য যতোটা প্রয়োজন।’ ভালবাসার জন্য কতটা প্রয়োজন ভেবে তুর্যর মন
আনচান করে ওঠে। আবার সুযোগ হলে সেই মন ধরে হাছন রাজা টান মারেন। তখন মস্তিষ্কে
ঢুকে পড়ে দুলতে থাকা সুস্মিতা, অন্যান্য পিচ্চি ও উর্ধ্বোতনরা ।
প্রমির কথা মনে হয়ে মন
ভারাক্রান্ত হয়। আত্মঘাতি মেয়ে। ঢাকা এসেছি, ওকে ফোন দিইনি, কোনভাবে জানতে
পারলে তুলকালাম ঘটিয়ে দেবে। ওকে ফোন দেয়া দরকার। ফোন কোথায়? আবার অবাক হয়
তুর্য, কখন নাচ থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আছে সুস্মিতা। তুর্য বলে ওঠে, ‘ওহ, তোমাকে যাদু
দেখাতে হবে তাই তো? চলো, ছাদে চলো।’ প্রমিকে ফোন করা
হয় না। এই টুকু মেয়ে একবার বলেছে, ‘এতো প্রেম করা লাগবে কেন?’ যাবার আগে ব্যাগ
থেকে তিন বক্স কাঁচের টুকরো নিলো সে। সুস্মিতার থেকে জোগার করে নিলো বাটাম, কাট, কাঠি, সুতো। ছাদে
সুস্মিতার প্রিয় জায়গা দেখে নিলো। তারপর সুস্মিতাকে আধা ঘণ্টার জন্য ছাদ থেকে
নামিয়ে দিলো। যাবার আগে বললো, ‘হাফ ঘণ্টা পর এসে তুমি অদ্ভুত কিছু দেখবে, অতএব গিফট হিসেবে
আমার জন্য লাইট লিগারের একটা দুধচা বানিয়ে নিয়ে এসো। নিজে বানাবে। যাও, যাও।’ ‘আচ্ছা’, বলে নাচের
ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে চোখমুখ ভর্তি উচ্ছাস নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো সুস্মিতা।
পেছনের পকেট থেকে বের করে ভাঁজ হওয়া সিগারেটটি নেড়েচেড়ে জ্বালিয়ে নিলো তুর্য।
তারপর শুরু করলো কাঠামো তৈরীর কাজ। রাস্তায় বোমাবাজির ধোঁয়া বিষ ছড়ালেও
সুস্মিতাদের ছাদে আজকের আকাশ তরতাজা পরিস্কার। এখনো রোদের তেজস্ব কুয়াশা গ্রাস
করতে পারেনি। ইতোমধ্যে উত্তরের কোনায় ঢু মেরে ক্যারম বোর্ডে দুটো গুটি ফেলে এলো
তুর্য।
এতো অপেক্ষার পর ছাদে
ফিরে হতাশ সুস্মিতা। কিছুই হয়নি। গ্রাম্য মেলায় এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটানোর খেলা
হয়,
বেলুনের জায়গায়
কতগুলো কাঁচ বসিয়ে একটা কাঠের কাঠামো তৈরী করে নিয়ে বসে আছে তুর্য। সুস্মিতার থেকে
চা নিয়ে আবারো একটা সিগারেট জ্বালালো সে। সুস্মিতা কাচগুলো ভাল করে লক্ষ্য করছে, নিশ্চয় এর মধ্যে
কোন ‘অদ্ভুত কিছু’ আছে। এলোমেলো সাজানো কাঁচ ছাড়া কিছু পাচ্ছে না
সে। তুর্য বললো, ‘যাও, এবার এয়ারগান নিয়ে এসো।’ সুস্মিতার মন
খারাপ, ‘আমাদের বাড়িতে এয়ারগান নাই।’ কিছুক্ষন থেমে
বললো, ‘তাহলে অদ্ভুত কিছু হবে না?’
‘অদ্ভুত কিছু হলে তুমি
কতটুকু খুশি হবে?’
‘চা খাওয়ানোর সমান।’
‘ওকে। ডান। লেটস গো।’
সুস্মিতাকে কাঠামোর পেছনে
নিয়ে সামনের দিকে আটকে রাখা পর্দা সরিয়ে নিলো তুর্য। বললো, চলো উত্তরে যাই, মঙ্গা দেখে আসি।
সুস্মিতা কিছু না বুঝে পিছু নিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটি নিস্তব্ধ বিকেল দেখা গেল।
নিস্তব্ধ এই অর্থে, এই আকাশ বড়ই পরিস্কার ও নীলচে। যে বাতাসগুলো
বয়ে যাচ্ছে এখান দিয়ে তার সবগুলোয় উর্বষী, হিমেল। গাছগুলোতে পাখির
কলরব একদম নেই। নিচের গলি, মার্কেট, পানের দোকান জনহীন।
মধ্যবাড্ডার এই উঁচু কাঠামো গুলো অট্টালিকার পরিবর্তে আজ নির্জন মঠে পরিনত হয়েছে।
কেবল কিছু শব্দ আছে। শব্দগুলো গুলি ও ককটেলের। হয়তো গন্ধ ও ধোঁয়াও আছে, নাগালে না থাকায়
আমি অনুভূতিতে পাচ্ছি না। অনুভূতিতে পাচ্ছি কোমল অনুষঙ্গ, সদ্য বালিকা ও
তার শরীরের গন্ধ।
সুস্মিতাকে অপরদিকে দাঁড়
করিয়ে ক্যারম বোর্ড সাজাতে লাগলো তুর্য।
‘আমাকে নাচ দেখাবে
সুস্মিতা, একা?’
‘আমার নাচ কেন দেখতে চান?’
‘তোমাকে দেখতে চাই।’
আমাকে কেন?’
‘তোমার বয়সী একজনের প্রেমে
আমি প্রথম পড়েছিলাম ও ডুবে গিয়েছিলাম। আমি এখন বুঝতে পারি না, ঐ টুকুন মেয়ের
মধ্যে কি ছিল, যাতে ডুবে গিয়েছিলাম। তুমি মাত্র একবার সুযোগ দিলে বুঝতে পারবো।’
‘স্যরি, নাচতে পারছি না।
আমি খুবই চালাক মেয়ে। বাবার চেয়েও।’
‘তার স্কোর কত?’
‘জানি না’।
‘তোমার?’
‘জানি না।’
খেলা চলছে গতিবিহীন। সাদা
কালোর কোন বালায় নাই। তুর্য আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। এ সিগারেটের ধোঁয়া
শক্ত গন্ধের জানাল সুস্মিতা। তুর্য হেসে পাড়ি দিলো। ফোনের সঙ্গে তার সব বন্ধ এখন, হাসন রাজা তার
মাথায় বেশি আসা যাওয়া করছে। সামনে তাকিয়ে প্রতি দৃষ্টিতেই সুস্মিতার মধ্যে নতুন
কিছু দেখছে আরও নতুন কিছু দেখার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে গুলি ও ককটেলের শব্দ ভালো
লাগতে শুরু করেছে। তুর্যর দৃষ্টিতে এখন আবিস্কার ও মস্তিষ্কে আরো কিছু শব্দঘটিত
শব্দের আসা যাওয়া। গুলি ও ককটেলের শব্দের পরিবর্তে আয়ুববাচ্চুর গিটার হলে বেশি ভাল
হতো, মনে হলো আরেকজন নেচে গেলে বেশি ভাল হতো। মনে পড়লো দীপিকা পাডুকনের মুখ ও
অন্যান্য অবয়ব।
আজকের মত মাথা ব্যাথা
শুরু হতে শুরু করেছে। এ অবস্থা কতদুর গিয়ে ঠেকবে বুঝতে পারছে না তুর্য। মস্কিষ্কের
কিছু কোষ গাজিপুর মোড়ের বিচ্ছিন্ন আঙ্গুলের লাফালাফি, চেয়ারম্যান বাড়ির
আতঙ্ক ও পাপুলের বাণী মেনে নিতে পারছে না।’ এ বিষয়াবলী নতুন। সুতরাং
ব্যথা অসম্ভাব্য।
‘তোমার আইকিউ স্কোর মেপে
দিতে পারি।’ তুর্য বললো।
‘সত্যি!’ ঝলমলিয়ে উঠলো
সুস্মিতা। মনে মনে নাচতে রাজি হলো। কিন্তু আজ তার পক্ষে নাচা সম্ভব নয়। আজ তার মন
খারাপ, বাবা অল্পের জন্য বেঁচে এসেছেন।
তুর্য বললো, ‘তবে যদি তুমি নাচ
দেখাও।’
‘ঠিক আছে, নাচছি না, তবে আমিও আপনাকে
চমকে দেব।’
‘ডান। প্রথমে আমি চমকে দিই, চলো।’
ফিরে কাঠামোর সামনে পর্দা
টানিয়ে দিলো তুর্য। সুস্মিতার হাত ধরে দেয়ালের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলো, সেখানে প্লাস্টার
পুড়ে কালো দাগ হয়ে লিখা রয়েছে ‘সুমিতা’। বাতাসে সুতো ছিড়ে যাওয়া
একটি এস’র কাছে সুস্মিতার বেড়াল ছানা ব্যায়াম করা শুরু করেছে। সুস্মিতা আনন্দে লাফিয়ে
উঠতে গিয়ে থেকে গেল। এখন লাফালে চলবে না, দেখতে হবে। সে দেখলো
একবার তুর্যকে, একবার দেয়ালের সুমিতাকে। তার চোখমুখ দিয়ে বিস্ফোরিত হচ্ছে উচ্ছ্বাস ও আতঙ্ক ।
সে তার সব আদর গলায় জড়িয়ে
কান্নাকান্œা স্বরে বললো, ‘ইস, আরেকটি এস খসে না গেলে ‘সুস্মিতা’ হতো। সে এক নতুন
বিকেলের মুখোমুখি যেটি সন্ধ্যা হতে চলেছে। তুর্য একবার হাতজোড় করে স্যরি বলেছে।
একটা ঘোর সুস্মিতাকে গ্রাস করেছে আর সে ইতোমধ্যে ভুলে গেছে আজ তার মত খারাপ, অল্পের জন্য বাবা
বেঁচে গেছে।
তুর্য’র মনে হলো একটা
উপন্যাসের কথা। বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে কি আরেক ফাল্গুন, জহীর রায়হানের
কোন একটা। ছাদে কে যেন কাকে প্রথম চুমু দিয়েছিল। তাতে যেন কার বুকে ঝড় উঠেছিল।
সুস্মিতাকে চুমু দিলে কি এখন এখানে বরফ গলা নদী তৈরী হবে? আলোর শক্তি দেখে
দারুন মুগ্ধ সুস্মিতা। আনন্দে কথা বলতে পারছে না। তার ইচ্ছে করছে নাচতে। কিন্তু
নাচতেও পারছে না। এর আগে একবার নাচতে গিয়ে দেখে, তার বাবার বন্ধু
লোকটা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তার এখন কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না।
এখনো একবার তুর্য’র দিকে তাকাচ্ছে, একবার দেয়াল পোড়া
সুমিতার দিকে। তুর্যও কিছু বলছে না। ঠোটে সিগারেট নিয়ে দিয়াশলাই খুলতে লাগলো সে। মুখভর্তি
কাঁপাকাঁপা রাগ নিয়ে হুট করে সুস্মিতা বললো, ‘শুনুন..’। তুর্য সিগারেট
জ্বালালো। থেমে গেল সুস্মিতা। তার মনে হয়েছিল, একটা লোক এতো সিগারেট
খাবে কেন, তাকে শাসিয়ে দেয়া দরকার। পরবর্তীতে তার মনে হলো, না খাক, এই লোকটা
হয়তো বিজ্ঞানী। তুর্য বললো, ‘বলো।’
‘সিগারেট টানছেন?’
‘হুম, তুমি টানবে?’
‘না, আমি সিগারেট টানি
না।’ একটু থেকে আবার বললো, ‘কি সিগারেট?’
‘গোল্ডলিফ’।
‘ভাল সিগারেট?’
‘না, কোন সিগারেটই ভাল
নয়। যাদু ভাল লেগেছে তোমার?’
সচকিত হলো সুস্মিতা। ‘হ্যাঁ, খুব ভাল লেগেছে।
কিন্তু আমার ভাললাগা বুঝাতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘সত্যি বলতে আমি আনন্দ
পেলে নেচে উঠি। কিন্তু আপনার সামনে আর নাচতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘আপনি বিজ্ঞানী, তাই।’
‘ধেৎ মেয়ে, যাদু দেখালাম, তোমার ইচ্ছে করলে
নাচতে পারো!’ সাহাব চা’র কথা মনে পড়লো, তার ধারণা, ‘তাড়না না থাকলে
সাফল্য সহজ হয় না।’ সুস্মিতা নামক সদ্য বালিকাটির হাসি, মুগ্ধতা, গন্ধে সে কি
তাড়নার সংস্পর্শ পেয়েছে, বুঝতে পারছে না। হাসন রাজা তুর্যের তাড়নার নাম
নয়,
আহ্লাদের।
সুস্মিতা বললো, ‘ঠিকআছে, আমিও আপনাকে যাদু
দেখাবো। আপনার যাদু সৃষ্টির জন্য তাই সাথে গিফট এক কাপ চা। আমি বানাবো। কিন্তু
আমার যাদু ধ্বংসের যাদু, তাই আমার গিফট লাগবে না।’ সুস্মিতা দৌড়ে
সিড়ির দিকে গেল। স্কার্ট পরায় তাকে আর পিচ্চি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে উড়ে যাচ্ছে
পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি, মনে হচ্ছে বাতাসে দুলছে ভেসে ওঠা পদ্ম, যার শরীরময় প্রতি
সেকেন্ড জমা হচ্ছে গাম, গন্ধ।
মিনিট পাচেকের মধ্যে চা
আর ক্যামেরা নিয়ে এলো সুস্মিতা। ওর ছবি তোলার হাত ভাল বলে অনেকগুলো ছবি তুললো
তুর্যর। বিভিন্ন মুডে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আজ আর যাদু দেখানোর সময় নেই, কাল। (লেখা চলছে)