শনিবার, ১০ মে, ২০১৪


http://mostafizio.blogspot.com/2014/05/blog-post_10.html

১০ টাকার দু:সংবাদগুলো

মুখোশটা কিনেই আনলাম এটা পরবো আমি মুখের দিকে আর তাকাতে পারছি না


লেখা চলছে


<><><>


http://mostafizio.blogspot.com/2014/05/blog-post_9530.html


আরেকটি হরতালে

 চেয়ারম্যান বাড়ি এসে মনে হলো আমার নিজস্ব দুটি পা মাটির উপর পড়ছে না। পা পড়ছে আতঙ্কের উপর। ফ্লাইওভারের নিচে মাঝখানটা থেকে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। কখনো একটা, কখনো অনেকগুলো একসাথে। সেই সাথে পুলিশের সাইরেন। গতিরপা দুটি রাস্তায় রেখে ফুটপাতে বসে পড়লো তুর্য। দৌঁড়াতে থাকা এক বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বললো, ‘এই ছেলে বোকার মত বসে পড়লে কেন, দৌঁড়াও, দৌঁড়াও

 গল্প, কিংবা উপন্যাস 


<><><>




এক একটি মানুষ 

একটি প্রবৃত্তিক উপন্যাস 






<><><>






শুভ সন্ধ্যা
এখন আপনার সামনে নৃত্য পরিবেশন করবেন রুম্পা
মিস রুম্পা


আরেকজন রাজা ও দুইজন পেয়ারির গল্প 


 
<><><>



http://mostafizio.blogspot.com/2014/05/blog-post_7883.html



‘এই শুয়োর জঙ্গি, বোমা বানায়, আপনি যান, কোথায় যাবেন?’

 নিজের গল্প। আর আমার ছেলের গল্প


<><><>


http://mostafizio.blogspot.com/2014/05/blog-post_7668.html


রাষ্ট্রপক্ষ এবং 

আমার ও পৃথা’র প্রেম ও ভালবাসা 

এমতাবস্থায় ভালবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়


<><><>

 

এক একটি মানুষ


অংশু মোস্তাফিজ
ফৌজদারি মামলায় আমি জেলখানায়। খুনের অভিযোগ। এর তিন নম্বর আসামী আমি। যারা খুন করেছে তিতাসের বাবা তাদের চেনেন। কিন্তু তার ধারণা যদি সত্যি না হয়, তাই তিন নম্বার আসামী করেছেন আমাকে। তিতাস আর আমি পাশাপাশি থাকি। কলেজপাড়ার শেষ মাথার একটি পাঁচ রুমের মেস, যেখানে তিনমাস ধরে কেবল আমি আর তিতাস আছি দুটো রুমে। পাশাপাশি রুম। ও ঘরে কথা বললে এ ঘর থেকে শোনা যায়। তিতাসের বাবা এসেছিলেন কয়েকদিন আগে। সম্ভবত ওর অন্তোষ্টক্রিয়া সেরেই। ভর দুপুর। আমি ঘুম থেকে জেগে একটা সিগ্রেট টানছিলাম যার মথ্যে গাঁজার পাতা ছিল। আমি একা থাকায় এ মেসে কেউ আসে না। তিতাস হারিয়ে যাবার পর আর কেউই আসেনি। ভালই কাটছিল আমার। সময়-গুলোকে খুব নিজের মনে হচ্ছিলো। কলিংবেলের শব্দ হলো। আবার হলো। কে আসতে পারে বুঝতে পারছি না। বেল আরো কয়েকবার বাজলো। আমি সিগ্রেট শেষ করে তবে গেট খুলতে গেলাম। তিতাসের বাবা এসেছেন। সাথে আরো দু’জন সমবয়সী। আমি বিছানা ঝেড়ে সবিনয়ে তাদের বসতে বললাম। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, তিতাসের জানাজায় যাওনি কেন? সিগ্রেট টেনে স্থির ছিল মাথা। তিতাসের জানাযা শুনে মেলাতে পারছিলাম না। জানতে চাইলাম তিতাসের জানাজা মানে কি? তিতাসের বাবা শব্দছাড়া কাঁদছেন। অন্যজন বললেন, গতকাল রাতে করতোয়া নদীতে পচানো পাটের নিচে তিতাসের লাশ পাওয়া গেছে। তুমি এটা জানতে না? না, বলে বসে পড়লাম আমি। একটা সিগারেট এবং একটা মিষ্টিজাতীয় চকোলেট নিতে ইচ্ছে করলো। আমি সেটা নিতে পারলাম। কেননা তখনই তিতাসের বাবা কান্না থামিয়ে বললেন সাবধানে থেকো। তারপর চলে গেলেন। গতপরশু পুলিশ আমাকে জেলে এনেছে। (লেখা চলছে)

নাম ঠিক হয়নি (গল্প)

শুভ সন্ধ্যা। এখন আপনার সামনে নৃত্য পরিবেশন করবেন রুম্পা। মিস রুম্পা। ইরার কণ্ঠ। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। প্ল্যান বুঝেছেন দি ড্যান্স এন্ড রিদম ইনস্টিটিউটের কোরিওগ্রাফার সুবিল সরকার। বিশাল সাইজের এক ডজন সাউন্ড সিস্টেম বেজে উঠলো। ততক্ষনে ভ্রুসন্ধির ভেজে আসা চামড়া ছেড়ে মাথা উঁচু করেছে প্রিতম। পাঁচ হাজার আসনের বিশাল বুলবুল মিলনায়তনের এই নাচসন্ধ্যায় আজ সে একা দর্শক। কালো টিশার্ট, চুজ থ্রিকোয়ার্টার পরা লকলকে এক তরুনী মঞ্চে উঠে এলো। এখনই রুম্পা থমকে যাবে। সামনে তাকালে দেখতে পাবে চার হাজার নয়শ’ নিরানব্বয় খালি চেয়ার রেখে মাঝের একটায় বসে আছে এক আনকোরা যুবক। ওর থমকে যাবার এ আয়োজন করতে প্রায় দু’বছর অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। সকাল নয়টা পাঁচটা অফিস করার পর সন্ধ্যা সাতটা বারোটা সিএনজি চালিয়েছে প্রিতম। পাশাপাশি রসুন মজুদের মত সিজনাল কিছু ব্যবসা করতে হয়েছে যাতে দ্রুত লাখ খানেক টাকা আলাদা করা যায়। বিশ হাজার টাকায় হলরুম ভাড়া, ত্রিশ হাজার টাকায় ড্যান্স এন্ড রিদম দল ভাড়া, সুবিল সরকারের জন্য দশ হাজার, পরবতী খরচের জন্য চল্লিশ হাজার।
রাহাত ফতেহ আলী খানের ও রে প্রিয়ার সাথে নাচ শুরু করলো রুম্পা। ঘুঙুরের শব্দ থেকে গেল সামনে তাকিয়েই। উরনে লাগাকিউ শেষ হয়ে তা না বা না তা না বা না চলাকালীন চেয়ারগুলোর মাঝখানে বসা কেউ একজনকে আবিস্কার করলো রুম্পা। আবছা আলোয় ধূসর চাদর জরানো শরীর, তার চোখে চশমা। চোখোচোখিতে সিগ্রেট জ্বলা বাম হাত নিচে নামিয়ে নিলো সরোয়ার। আবারো ও রে প্রিয়া বাজালেন সুবিল সরকার। রুম্পা নাচলো। উতাল নাচ। শাওনো গগনে ঘোর ঘণঘটা, চাঁদনি চাঁদনি রাত হ্যায় থেকে দুর দ্বীপ বাসিনিতে এসে থামলো রুম্পা। এক দৌঁড়ে ফিরে গেল সাজঘরে। উদ্বিগ্ন সুবিল সরকার। বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। রুম্পা ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করলে তার এই আমুদে চাকরির সর্বনাশ ঘটবে।
প্রিয় দর্শক, এখন আপনার সামনে নাচ শুরু করবো আমি। ইরা। মিস ইরা। মাইকে নিজের নাম ঘোষণা করে নাচ শুরু করলো ইরা। মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোপায় তারার ফুল। তার পরের ভাষা বুঝার সাধ্যি নাই, আরবী ভাষার গানে শরীর ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মেতে উঠছিলো ইরা। এই সেই ক্ষণ, যার জন্য প্রিতমের দু’বছর বিনিয়োগ। পকেট থেকে কলকি বের করলো সে। আর তাতে আগুন দিয়ে গেল সুবিল সরকার। আরো দু’চেয়ার এগিয়ে প্রিতম মনোযোগ স্থাপন করলো ইরার শরীর ভাঙ্গা মিউজিকে।      

রাষ্ট্রপক্ষ এবং আমার ও পৃথা’র প্রেম ও ভালবাসা


অংশু মোস্তাফিজ

বাংলাদেশে প্রেমিকদের জন্য দুঃসময় চলছে। একজন প্রেমিক হিসেবে এবং অন্যান্য প্রেমিকদের দেখে শুনে বুঝতে পারি, এ সময় প্রেমের সহয়ক নয়। বাংলাদেশ প্রেমিকদের জন্য নিরাপদ নয়, নিরাপদ ভিলেনদের জন্য। ভিলেনরা ফিল্মি স্টাইলে প্রেমিকদের দমন করছে। ভিলেনের ভূমিকায় কখনো রাষ্ট্রপক্ষ, কখনো রাষ্ট্রীয় পক্ষ এবং অন্যান্য পক্ষ/ মহল অবস্থান নিচ্ছে। এখানে প্রেম করার অপরাধে প্রেমিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আবার নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রতিটি অংশে দুর্নীতির নখ প্রেমিকদের জীবনকে করে তুলছে অস্থির। ফলে প্রেমিকরা ক্রমেই প্রেম থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা, কেবল বেঁচে থাকার জন্য এতোটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, তাতে প্রেম করার মত সময় হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটেও এমনটি দেখা যাচ্ছে। এখানে দেশপ্রেমিকদের জীবনযাত্রা অস্থির করে তোলা হয়েছে। কিন্তু কথা বললে, সমালোচনা করলে, ভিন্নমত পোষণ করলে, নায্য দাবী করলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিংবা ভিন্নমত পোষণকারীদের শায়েস্তা করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে ক্ষমতাশালী দল ও তাদের সহযোগী অজস্র সংগঠণ। আর আমরা এগুচ্ছি শাসন-শোষণ শব্দগুলোর মধ্য দিয়ে।
এমতাবস্থায় ভালবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এমনটি প্রয়োজন বলে মনে করি না। আমার এক সূচি বন্ধুর দাবী, ভালবাসতে হলে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিতে হবে। এমনকি শতাধিক নীলপদ্মও যোগাড় করা লাগতে পারে। আমি তার কথায় দ্বিমত পোষণ করে নাতাশার কাছে যাই। নাতাশা এক বালিকা বধূ। বালিকাই বলবো, প্রেমের টানে ঘর করতে বেরিয়েছে পনের বছর বয়সে। যে জন্য নাতাশার কাছে আসা, সেগুলোর পর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় থুতুনি লাগিয়ে দোলাতে দোলাতে সে বললো, ‘আমার খুব ইচ্ছে করে দিনের সবটুকু সময় তোমার সাথে থাকতে। কিন্তু আমার এই সুবর্ণ সময়ের জন্য সপ্তাহ কাল অপেক্ষা করে থাকতে হয়’। জিজ্ঞেস করি, ‘এই ফিল এর নাম কি?’ আহ্লাদ করে নাতাশা বলে, ‘ভালবাসা।’ জিজ্ঞেস করি, ‘কার জন্য?’ সে বলে, ‘ তোমার জন্য ’। তৌফিকের কথা জিজ্ঞেস করি, মন খারাপ করে মাথা থেকে থুতুনি সরিয়ে নেয় সে। বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি সম্বিত ফিরে পাই। লুকোচুরি করে টিকে থাকা এ শহরের গল্প আমি জানি। ভালবাসার জন্য আমার মতোই ভুল মানুষ বাছাই করেছে তৌফিক। নাতাশা নামের এই মেয়েটির নাম ‘নাতাশা’ নয়। তথ্যটা জানিয়েছে তৌফিকই। মাস তিনের আগের এক আড্ডায় ছেলেটির সাথে প্রথম পরিচয়। তার দু’চার দিনের মধ্যেই সে তার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সব জেনেশুনে পরদিন বেলা এগারটার দিকে ফোন করেছে মেয়েটি। তার দাবী তৌফিকের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন তাকে গাঁজা খাওয়াতে হবে। বিষয়টিকে অবাঞ্ছিত মনে হলেও বিভিন্ন কারণে তার অফার ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সত্যি বলতে কোন সুন্দরীর দাবী ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে প্রতিদিনের দাবীকে সাপ্তাহিক পর্যন্ত টেনে নিয়েছি।
মম’র কথা বলতে পারি। এই মেয়েটি রোজ বিকেলে ছাদে দাঁড়ায়। পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলি, সে দেখে, গোল দিতে পারলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। মম’র ছাদ আর আমার ছাদ পাশাপাশি হওয়ায় টপকানোর ব্যাপারটি সহজ হয়েছে। হাইস্কুল থেকে অদ্যবদি চুমুবিনিময় করা প্রেমিকাদের কথা বলতে গেলে, আমি আরো বেশ ক’জনার কথা বলতে পারবো। এ পর্যন্ত এসে মনে হচ্ছে আমি ষন্ডা টাইপের কেউ? ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়। প্রত্যাহিক জীবন বাঁচাতে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি, ভালবাসা আসলেও পাওয়া যায় কি না, আমি খুঁজছি। দেখছি নাতাশা, মম থেকে পৃথা- সবার অবস্থাই এক। এরা প্রেমকেই বলছে ভালবাসা। আমার ভাল লাগে না। তবু যাবার জন্য পৃথার কাছে যাই। স্বচ্ছ জীবন যাপন করে। কিন্তু সে স্বীকার করে নিয়েছে, তার পক্ষে এগিয়ে আসা সম্ভব নয়। সে স্বীকার করে নিয়েছে, মানবিক সব দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে তার পছন্দ। ভালবাসা পছন্দ, কিন্তু কেবল প্রেমকে অধিক গুরুত্ব দেয়া পৃথার কাছে যাবার কারণ সে অন্তত মানবিক দাবীগুলো বুঝতে পারছে।
পৃথাকে বললাম, ‘তোমার ভবিষ্যৎ বলো।’ এক কথায় সে বললো, ‘অন্ধকার।’
চমকে উঠলাম, এই স্বচ্ছল মেয়েটা অন্ধকার দেখছে কেন?
নি¯প্রভ হয়ে বললো, ‘আমি কেবল এখানে নারীমাত্র। বড় হতে চাইলে, পণ্য। আর গতানুগতিকে কূলবধু। মানুষ হিশেবে এই দুটি অপমানের সাথে ‘ধর্ষণ’ নামক একটি ভয় সব সময় তাড়া করে ফিরছে। সবখানে। স্কুল, মাঠ, অফিস, এমনকি স্বামীর ঘরে, এমনকি নিজের ঘরে।’
মে বি সুজান গ্রিফিন নামের এক মহিলার কথাই পড়েছিলাম। যিনি উপলব্ধি করে এমনটি বলেছিলেন, ‘একটা মেয়ে মাঠে যাবে, সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। একটা মেয়ে স্কুল কলেজে যাবে, সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের।’ 
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো ভয় পাচ্ছো কেন?’
‘একমাসের খবরের কাগজে কতগুলো ধর্ষণের খবর থাকে জানো? খবরগুলো পড়েছো কখনো? পৃথা জানতে চাইলো। বললাম, ‘হ্যাঁ আমি জানি।’ পৃথা বলল, ‘এবার আমাকে বলো সভ্যতা কাকে বলে? যে দেশে হাইস্কুলে যাবার পথে এক একটি মেয়েকে মাইক্রোবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতেই থাকে, সে দেশকে সভ্যতার মাপকাঠিতে তুমি কিভাবে বিচার করবে? অসুস্থ্য একটি নতুন বউ শহরে ডাক্তার দেখিয়ে গ্রামে ফেরার পথে যখন গণধর্ষণের শিকার হন, তখন এটাকে কেন ‘অসভ্য’ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করবে না? চার বছরের এক বাচ্চার ধর্ষিতা হবার খবর পড়লাম সেদিন, আমার মনে হলো, শিশুটি কেবল মেয়ে হবার অপরাধে জন্মেই জানলো, তার জন্য আরো অনেক বিভৎসতা অপেক্ষা করছে। এক মাসের খবরের কাগজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ জন নারীর বিভৎস হবার ঘটনা আমি জানি। সেটা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সমাজের সব স্তরের।’
কিছুক্ষণ থেকে পৃথা বললো, ‘আমি যে নারী, আমার ভয় করে? একজন নাগরিক হিসেবে যখন দেখি, কেবলই মনে হয়, আমি যে দেশের নাগরিক, সে দেশ ধর্ষণপ্রবণ। কিন্তু আমি যখন স্কুল কলেজে পড়েছি তখন জাতীয় সঙ্গীতে গেয়েছি, ’আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি..’। অথচ জানো, সোনার বাংলার সাথে জড়িয়ে পরা এই দুঃসহ শব্দগুলোকে আমি প্রতিদিন ঘৃণা করে যাচ্ছি।’ 
মোবাইল ফোনের ব্যালান্স শেষ। কল ব্যাক করে বললাম, ‘পাশের দেশ ইন্ডিয়া স্বীকারই করে নিয়েছে, তারা নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আমরা তো ঐ পর্যায়ে যাইনি। আমিও স্বীকার করছি, এটা অন্যায়। তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পৃথা।’ পৃথা অটল। ‘ক্ষমা আমি করবো না।’ ‘তাহলে ভালবাসো কিভাবে?’ ‘ভালবাসি না’। ‘তাহলে?’ পৃথা বললো, ‘তাহলে প্রেম।’
আমি বললাম, ‘প্ল্যাকার্ডে সভ্যতার সংজ্ঞা লিখে রাস্তায় নামছো না কেন? সেদিন ‘প্রটেস্ট ফ্রম নাইটিনাইন’ বুকে লিখে মশাল হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম, তোমাকে ডেকেছিলাম, তুমি আসো নি কেন?’
পৃথার উত্তর, ‘তোমরা সচেতনভাবে অসভ্যতাকে বরণ করবে, আর তার জন্য আমার স্বচ্ছ জীবন ছেড়ে রাস্তায় নামতে হবে কেন? তোমরা ভাল হতে পারো না?’
আমি বললাম, ‘পারি। কিন্তু কেবলমাত্র ধর্ষণের ভয়েই তুমি ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’ বলতে পারো না। তুমি সাহসী মেয়ে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক। আমি সাহসী। আমার সামনে দাঁড়ানোর ব্যক্তিত্ব অন্তত কোন ধর্ষকের নেই। কিন্তু আমার দূঃখ, মেয়েগুলোকে চার বছর বয়স থেকে প্রতিদিন ধর্ষণের ভয় সামলে নিয়ে ছেলেদের সমমানে আসতে হয়, তারপর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার জন্য রাষ্ট্রের মুখোমুখি হতে হয়। এখানে এসে আমি তোমার সমান। তোমার ভবিষ্যৎ কি?’
সত্যি বলতে পৃথার বাক্যগুলোর মৌলিক দিক ভেবে আমি হতাশ। আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রীগণ আমাদের এক হাইস্কুলের বেতনভোগী শিক্ষকের আঁচড় থেকে ক্লাস সেভেনের ছাত্রীকে রক্ষা করতে না পারায়, একজন নাগরিক হিসেবে আমি হতাশ। একজন আমেরিকান প্রেমিক যত সহজে তার প্রেমিকাকে পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেমিকদের জন্য সেটা ততটা সহজ নয়। প্রেমিকাদের জন্যও সেটা ততটা সহজ নয়। ফলে পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন প্রেম সংক্রান্ত দুর্ঘটনার খবর দেখি। এ জন্য দায়ী আমাদের সমাজ কাঠামো। পুরনো রীতি পাল্টাবার সৎ সাহস না থাকা। নতুনকে স্বাগত না জানাবার মত অজ্ঞতা। পৃথা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার ভবিষ্যৎ কি?’
বললাম, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে চলতি বছর ভাবিনি। একটু সময় ভেবে নিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি। বাই।’
আমার সূচি বন্ধুর সাথে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে দেখা। শুরুতেই বন্ধু বললো, ‘ভালবাসার দুঃসময় চলছে।’ ‘বন্ধু ঘটনা কি? আছো কেমন?’ বন্ধুর মন খারাপ। দুঃসংবাদটি জানালো সে। সম্প্রতি বগুড়ার বেসরকারি ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক থেকে সম্ভবত ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ৭২ জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রত্যককে জড়িমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খবরটি নাম, ছবি, ঠিকানাসহ স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাদের অপরাধ দিনের বেলা পার্কে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা।
আমি বললাম, ‘পুলিশ কাজটা ঠিক করেনি। তাদের কাজ নাগরিকদের প্রেমের নিরাপত্তা বিধান করা, গ্রেপ্তার করা নয়। তারা চোর নয়, তারা প্রেমিক, তারা প্রেমিকা। ভন্ডামোর রাজনীতি চর্চা করে না, তারা প্রেম চর্চা করে। পার্কে দু’চারজন হয়তো অসভ্য হয়, কিন্তু বেশিরভাগই আসে প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্তরসুরী হয়ে, ধর্মপ্রিয় সমাজের থেকে একটু আড়ালে, হয়তো প্রেমই, হয়তো ভালবাসার জন্য। আর বগুড়ার প্রধানতম পত্রিকা এখানে প্রতিক্রিয়তাশীলতার বীজ পরিচর্যা করেছে। তো, বন্ধু তোমার মন খারাপ কেন? তুমি কি জোড়াগুলোর একজন?’ বন্ধু মন খারাপ করে জানালো, ‘জোড়ার একজন আমার প্রেমিকা, ছেলেটা আমি নই।’ বন্ধু অন্যদিকে মুখ ফেরালো। একটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে দিলাম। ‘কামান বয়, এনজয়।’ বন্ধুর সঙ্গে আরেকদিন দেখা হয়েছিল, জানিয়েছে সে এনজয় করছে এবং ভালবাসা খুজছে।
যা কিছু দেখছি, তাতে খুব আশাবাদি মানুষ আমি নই। আমি জানি, সূচি বন্ধুটি ভালবাসা পাবে না। নাগরিকদের ভালমন্দ দেখার এজেন্সি নেয়া রাষ্ট্র চালকরা দেবে না। প্রেমিকাও দেবে না। ঘুরে ফিরে ওর সাথে দেখা হবে কোন এক নাতাশা, এক মম। ঘুরে ফিরেই দেখা হবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কালো বিড়াল, সবুজ হাতি, নীলপরিদের সাথে। আমি জানি না, সে পৃথাকে গ্রহণ করবে নাকি লুফে নেবে? পৃথার সাথে কথা বলা দরকার, ও জানতে চেয়েছে, আমার ভবিষ্যৎ কি? কোন কিছু চিন্তা করার আগে যেটা মাথায়ও আসছে সেই শব্দটি হচ্ছে ‘অন্ধকার’। পৃথাকে কি বলবো?
‘পৃথা, একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুব অস্থিরতা অনুভব করছি। দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর দেশে আমি ও আমার মত এক একজন নাগরিকের জন্য কেবল অপেক্ষা করে আছে হতাশা।
তাছাড়া রাষ্ট্রের ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের যা অবস্থা করছে, তাতে এখানে নাগরিক হিসেবে বাঁচা প্রায় সময়ই অপমানজনক হয়ে ওঠে! ‘তাদের’ নিকৃষ্ট গণতন্ত্রচর্চা প্রতিটি নাগরিককে অস্থির জীবনযাপনে বাধ্য করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্রতায় একদম সুখী হতে পারি না আমি, আর আমরা।’ পৃথাকে আমি বলতে পারি, ‘ আমাদের ভেঙ্গে পড়া সংস্কৃতি নিয়ে আমি শংকিত। বিশাল সংখ্যক রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে দেখায়, বিশাল সংখ্যক প্রশাসক প্রশাসনকে ব্যবসা হিসেবে দেখায় ক্রমেই রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিটি ইট নড়বড়ে হয়ে উঠছে, আর তার মাসুল দিচ্ছি কিছু সুবিধাবাদী ছাড়া অবশিষ্ঠ চৌদ্দ/পনের কোটি মানুষ। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রের সাথে আমার সম্পর্কের জায়গাটি দেখতে গিয়ে মনে হলো সম্পর্কের অবস্থান একেবারেই স্বস্থিকর নয়। রাষ্ট্র তার প্রতিটি অঙ্গকে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণ বানিয়ে, নাগরিকদের বানিয়েছে ক্রেতা। 
সরকারের পরিচালনা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাণের দিকে তাকালে আমরা কিছু অদ্ভুত চিত্র দেখতে পাই। এইসব চিত্রের কথা পৃথাকে বলবো। স্বচ্ছল জীবন ছেড়ে সে যদি একবার সরকার পরিচালিত হাসপাতালে যায়, দেখবে, গ্রাম থেকে আসা এক বৃদ্ধ রোগির সাথে থাকা অশিক্ষিত মহিলাটি রাত তিনটেয় ডিওটিতে থাকা সিস্টারদের রুমের দরজা নক করতে করতে বলছে, ‘আপা তারাতারি আসেন, কখন জানি স্যালাইন শেষ হয়ে ব্যাগে রক্ত উঠছে।’ ভেতর আপা যেটা বলেন, সেটা একজন নাগরিক হিসেবে সহ্য করা পৃথার জন্য অপমানজনক। আমরা রেলওয়ে স্টেশনে যাই। কিছুক্ষণ স্টেশন মাস্টারের সামনে দাঁড়াই, শুনতে পাবো কেউ কেউ বলছেন, যেন জমিদার বসে আছেন! পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, শিক্ষা, সেবা, টেলিফোন, প্রশাসন, , , , ।
পৃথাকে বলবো, ‘জীবন ধারণের উপযোগী পঁচিশ ধরণের কাজ পারি আমি। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে কাজের দাবী নিয়ে আসার যোগ্য নই। কেননা, চাকরির জন্য ঘুষের ভাগাভাগির কথা এখন সংসদে আলোচনা হয়। মন্ত্রী সাহেবরা প্রকাশ্যে জনসভায় বলে ফেলেন, তার দল না করলে চাকরি সম্ভব নয়। আর সাম্রাজ্যবাদের এই সময়ে গড়ে ওঠা প্রাইভেট সেক্টরগুলো নিজেদের কাঠামো তৈরী করেছে রাজত্ব অনুসারে। ফলে প্রতিটি স্তর গড়ে উঠছে কেউ কেউ রাজা এবং অবশিষ্ঠ ভৃত্য হবার মানসিকতা নিয়ে। আমার ভৃত্য হতে ভাল লাগে না। ব্যবসা এবং অন্যান্য কাজে যাই। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি সরকার এবং তাদের পোষ্য সংগঠণগুলোর কান্ডকারখানা। আমার সামনে ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠে ‘লীগ’, ‘দল’, ‘ছাত্র’, ‘যুব’, ‘স্বেচ্ছাসেবক’, ‘শ্রমিক’ ইত্যাদি ইত্যাদি ‘অমঙ্গলজনক’ শব্দ। আজব হয়ে দেখতে থাকি, আমার সমর্থণে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার নিয়ে আমার সাথে যা’চ্ছে তাই করার পাঁয়তারা করছে এবং করছে। তার নিয়ন্ত্রাণাধীন প্রতিষ্ঠাণে আমাকে আসতে বাধ্য করে দুর্নীতি করছে। প্রতিষ্ঠাণের বাইরে আবার তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে ‘লীগ’, ‘দল’, ‘ছাত্র’, ‘যুব’, ‘স্বেচ্ছাসেবক’, ‘শ্রমিক’ ইত্যাদি ইত্যাদি ‘অমঙ্গলজনক’ শব্দ।
নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কাজের ব্যবস্থা করতে না পারায় আমি হতাশ। তোমার মতই প্রতিদিনের খবরাখবরে আমি ভীত ও আতঙ্কিত। কিন্তু খুব দুঃসংবাদপ্রিয়। দুঃসংবাদ পড়ার জন্য আমি প্রতিদিন ২০ পৃষ্টা কাগজ কিনি। কখনো কখনো মনে হয়, এই দেশ থেকে কেটে পড়ি, ককটেল, খুন, সংঘর্ষ, গুলি, হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট, হরিলুট, দুর্নীতি, দুর্নীতি,,, শব্দগুলোর অত্যচারে ক্রমেই কাহিল হয়ে পড়ছি। কেটে পড়তে পারি না, শেকড় টেনে ধরে।
‘পৃথা, এতোসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে বেঁচে থাকার মাঝে আলাদা করে প্রেম পরিচর্যার সময় আমার নেই। আমি যুগযুগ ব্যয় করেছি মেরিলিন মনরো, ঐশ্বর্য রায়, দীপিকা পাডুকন, সুচিত্রা সেন কিংবা সানি লিওন, এমা ওয়াটসনের প্রেমে। তুমিও দিচ্ছো, আমি নিচ্ছি। কিন্তু আমার যে ভালবাসা দরকার। আমি ভালবাসা খুজছি।’
কিন্তু ভালবাসাতে গিয়ে কেবলই দেখি মলিন হয়ে আসা পথশিশুর মুখ। তিন ডিগ্রি তাপমাত্রায় স্টেশনের রাত্রিবাস, ঝড় ভাঙ্গা মানুষের কান্না। ভালবাসতে গিয়ে আক্রোশে ফেটে পরি নিরন্ন মানুষের চালচিত্র দেখে। আমি দিনমান এইসব দেখি এবং ভালবাসতে থাকি। আমার ভালবাসা পৌছে দিই মুশফিকুর রহিম, সালমান খান থেকে অ্যাসাঞ্জ, স্লোডেনকে। শিল্পকলা ও আবিস্কারের নেশায় যার চোখ উষ্ণ ও শীতল হয়, তার জন্য ভালবাসা দিই। কখনো কখনো রাজনীতিবিদদের ভালবেসে চিঠি লিখে আবার ডিলিট করি, নায্য দাবীর জন্য আন্দোলন যে প্রিয় বলে তাকে ভালবাসতে থাকি। মানবাতার ধর্মে যে দিক্ষিত হতে চায়, তাকে এগিয়ে যেতে আমার সবটুকু ভালবাসা সমর্পণ করি।
কিন্তু পৃথা, কেবল সংকট। উপমহাদেশ ব্যাপি। 
এইসব সংকটে আমার ভালবাসা উতলে ওঠে। উপদ্রুত মানবতার জন্য প্রেম শক্তিশালী হয়। নাজরিনে পুড়ে মরা একশ’ এগার ছাইভস্ম শরীর কিংবা রানা প্লাজার ধসে পড়া ইট পাথরের নিচে চ্যাপ্টা হওয়া আত্মাগুলোর প্রতি আমার ভালবাসা পৌছে গেছে। প্রতিটি উপদ্রুত আত্মার জন্য আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। আমি মুহূর্ত্বেই ভালবেসে ফেলি যারা সৃষ্টিশীল ও অসহায়।’
পৃথার কাছে জানতে চাইবো, শ্রেণী বৈষাম্যের এই দুর্দান্ত সময়ে একটি প্রেমের কবিতায় কতটুকুন উর্বরা হবে স্বদেশ ভূমি, কাটফাটা রোদ কমবে কতটুকু চুম্বনে? নায্য বেতনের দাবীতে আশুলিয়ায় লাখ লাখ নারী যখন রাস্তায় নামে, শ্লোগান দেয়, তখন মনে হয় এদের একজন আমার প্রেমিকা, যাকে আমি ভালবাসি। তার শ্লোগানমুখর মুখ আমাকে প্রেমে পড়তে অনুপ্রেরণা দেয়। 
পৃথাকে বলবো, ‘প্রিয় পৃথা, আমি অনেকবার তোমাকে ভালবাসি বলেছি, ভালবাসি লিখেছি, কি এমন পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের, সেই নিরন্ন মুখ, ক্লান্ত যুবকের ঘুমবিমুখ রাত্র। তাকে আহ্বান জানাবো, তোমার স্বচ্ছ জীবন থেকে নেমে আসো, সত্য ও সুন্দরের জন্য ‘আন্দোলন’ ভালবাসো। বিছানার পাশাপাশি ‘প্রটেস্ট ফ্রম নাইনটি নাইন’-এ আমি এলে, তুমিও এসো। না এলে জানিও, কেন আসবে না? ভাল না বাসলে জানিও, কেন বাসবে না?


নাম ঠিক হয়নি

অংশু মোস্তাফিজ

ছেলের লাশ কাঁধে নেবার প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম। কিছু টাকাও গুছিয়ে রেখেছিলাম জানাযা পরবর্তী খরচের জন্য। বেচে গেছি, কোন টাকা লাগেনি। হাড্ডি মাংসগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ, জল্লাদ পুতে দিয়েছে।’
দু'টো সিগারেট জ্বালিয়ে একটা এগিয়ে দিলো তারিক।
‘এসব কি বলছেন?’
চোখমুখ মুছে গামছা রাখতে রাখতে কাঁধ বাঁকিয়ে সিগারেট নিলেন তিনি।
‘হ্যাঁ, গল্পই তো বলছি। সত্য গল্প। নিজের গল্প। আর আমার ছেলের গল্প। শুনতে না চাইলে বলবো না। রাজা রানীর গল্প শুনবেন?’
তারিক বললো, ‘না কাকা, বিষয়টা ওরকম নয়, আপনার বলা শব্দগুলোয় কেবল আতঙ্ক। তাই বলছিলাম। গল্প বলেন, আজকে নিজেরটাই বলেন, ভাল লাগলে আরেকদিন রাজা রানীরটা শুনতে ডাকবো। চলেন, তার আগে চা খেয়ে নিই। গুর দিয়ে বানানো চা পাওয়া যায়, সেখানে চলেন।’
কাকা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘চা তো ছেড়ে আসলাম, এদিকে আর গুরের চা নাই।’
তারিক বললো, ‘ফিরে যান।’
বিএল কলেজের সামনে থেকে মোড় ঘুরলো রিকশা।  
তার সাথে দেখা রূপসা সেতুর নিচে। এরশাদ শিকদারের খাতিরে তার সাথে পরিচয়। সেতুর পূর্ব এলাকায় থাকা তারিক পশ্চিম পাশে গিয়ে তিনশ’ টাকা দিয়ে চার ঘণ্টার জন্য রিকশা ভাড়া করেছে।
বাড়ির নাম স্বর্ণকমল। ফলকের পাশে দাঁড়িয়ে তারিক এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো, বাড়ির তুলনায় নামের আলো বেশি। পরিচয়পত্র দেখিয়েও ভেতরে ঢোকা গেল না। ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল, জনাব শিকদার সাহেবের এই বাড়িটি দেখার। তার গল্প ছিল রোমাঞ্চকর সহিংসতার। সে সময় এরশাদ শিকদারের আপডেট তথ্য নিয়ে বাজারে পুস্তিকা পাওয়া যেত। তার দেয়ালের ভেতরে বাঙ্কার থাকার কাহিনী রোমাঞ্চিত করেছে। মনে হয়েছিল একবার দেখে আসি। আজ কাছাকাছি এসেও বাঙ্কার দেখা হলো না।
চাচা, চালিয়ে যান, আপনার যে দিক ইচ্ছা করে।
পেডেলে পা রাখলেন চাচা। ছয় বছর পর খুলনা এলো তারিক। ছক কষে নিচ্ছে সে, কার কার সাথে দেখা করা যায়, কার সাথে আগে, খুলনায় কি ওর ভাল কোন বন্ধু ছিল? ‘ধুর!’, বললো তারিক। তার বন্ধুই কখনো ছিল না। ভাল বন্ধু তো নয়’ই। কাল বাগেরহাট যেতে হবে। খান জাহান আলী মাজারের কুমিরকে আগেরবার সে বলে গেছে, ‘আবার দেখা হবে’।
উল্কা সিনেমা হলের সামনে রিকশা দাড় করালো পুলিশ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লোকটিকে গামছা দিয়ে বেধে ফেললো। তারিক বললো, ‘ঘটনা কি?’ ‘ঘটনা আছে, আপনি নামেন’, ওর দিকে এগিয়ে এলো একজন। খালি রিকশা ডেকে তুলে দিয়ে বললো, ‘যান, এই শুয়োর জঙ্গি, বোমা বানায়, আপনি যান, কোথায় যাবেন?’
(লেখা চলছে)

আরেকটি হরতালে (গল্প, কিংবা উপন্যাস )

অংশু মোস্তাফিজ

ঈদের পরে তুর্য ঢাকা শহরে যে দিন পা রাখলো, সে দিন হরতাল শুরু। বাসের টিকিট কেনার সময়ও সে জানতো না। অর্ধেক রাস্তায় আসলে ফোন করলো চাচা। তুর্য জানিস কিছু? ‘কি বিষয়ে?’ চাচা উদ্বেগ নিয়ে বললো, ‘হুট করে তিন দিনের হরতাল ডেকেছে। ভোর থেকেই কার্যকর। তোর বাস কোথায়?’

যমুনা সেতু।শব্দটি বলতে বলতে কাঁধ উঠিয়ে বাইরে তাকাল তুর্য। ঐ যে মাঝখানে জেগে ওঠা কাশচর, কলেজের পিকনিকে ঐখানে গিয়েছিল সে। ছোট একটি খেয়া, রিমঝিমকে ভালবাসার গুরুত্ব বুঝাতে সবার অগোচরে তাকে কোল থেকে নামিয়ে বৈঠা ধরেছিল তুর্য। সেদিনের তিনটে ছবি এখনো রয়েছে ফোন মেমোরিতে। এইসব ঐহিহ্য মূহুুর্ত্বে খেলে গেল মস্তিষ্কে। সাহাবচা বলেই চলেছেন। 
এখন দুটো চল্লিশ। একটা কাজ কর, বাস থেকে নেমে পড়। আশেপাশে কোন হোটেল দেখে উঠে পড়। তিন দিন পরেই রওনা দিবি।
তুর্য বললো, ‘চাচা, দরকার নেই। সকাল হবার আগে আগে পৌছে যাবো।
চাচা বললো, ‘দরকার আছে। এই শোন, সারাদিন হোটেলে বসে থাকবি। টিভি আছে এ রকম রুমে উঠবি। আমি বিকাশকরে হোটেল ভাড়া পৌছে দিচ্ছি।
তুর্য আবার বললো, ‘ শাহাবচা দরকার নেই। তুমি আমার জন্য চিন্তা করছো, এটাই ভরসা, পৌঁছে যাবো।
চাচা এবার সুর নরম করলেন। অভিভাবকত্ব অধ্যায় শুরু। তুর্য, শোন বাবা, ধর রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিস, পাশে ফুটপাতও আছে, সে ক্ষেত্রে ফুটপাত দিয়ে যাওয়াই ভাল, তাই না? তোর পেছনে একটা ট্রাক ছুটে আসছে, ভাল ছেলে বলে তুই হয়তো ভাবছিস, রাস্তায় অনেক জায়গা আছে, ট্রাক তোকে মারবে না। কিন্তু আমার ভয় করে, ট্রাক ফুটপাত ভেদ করে দোকানঘর এমনকি বসতবাড়িয়ে ঢুকে পড়ে মানুষ মারে। এমন ঘটনা ঘটতেই আছে। বাংলাদেশে চালক হতে সিগনাল চেনারও প্রয়োজন হয় না।তুর্য চোখ বন্ধ করে শুনে যাচ্ছে। আজকাল হরতালে কি হয়, তুই জানিস, আমিও জানি। হরতাল মানেই সহিংসতা, রিস্ক নেবার কি দরকার? তুই খুবই ভদ্র একটা ছেলে। এবার উঠে পড়। দ্রুত বাস থেকে নেমে হোটেল বের কর। কি হয় জানিয়ে ফোন দিস। রাখছি।
রাস্তায় এতোগুলো লোকের কি হবে, হরতাল আহ্বানকারীরা যে সে চিন্তা করেন না, তুর্য জানে। অন্য চিন্তা করছে সে। হুট করে হরতাল জেনে রাস্তায় থাকা হাজার হাজার লোক নিশ্চয় তিন দিনের হোটেলে উঠবে না। হরতালের কথা কাউকে বলার দরকার নেই। যেমন যাচ্ছে, যাক। সকালের আগে পিকেটাররা রাস্তায় নামবে না। ভাগ্য বশত সুযোগ পেয়ে যায় তুর্য। সেতু পার হয়েই বাস থামে। এক বুড়ো বমি করে তিন চারজনের গা মাখিয়ে দিয়েছে। ঐ তিন চার জনও বমি করেছে। ম্যাসাকার অবস্থা। বাস থামিয়ে পরিস্কার পর্ব চলছে। এই সময়ে চাচাকে ফোন করে তুর্য, ‘অবাক ঘটনা ঘটে গেছে। সুপারভাইজারকে হরতালের খবর বলার সাথে সাথে উনি তা প্রচার করে দিলেন, আর বাসের সবাই ডিসিশন নিলো, আশেপাশের কোন হোটেলে থাকবে। একটি তিনতলা হোটেলের সামনে বাস দাড়িয়েছে। কয়েকজন ভাড়া ঠিক করছে। আমারও ভাল হলো। ক্ষুধা লেগেছিল, এখন খাওয়া যাবে। কোন চিন্তা করো না শাহাব চা, ঘুমিয়ে পড়ো। জেগে ফোন দেবো।
চাচা বললো, ‘দেখছিস তো, সবাই এখন সচেতন হয়ে উঠছে। দুর্বৃত্ত বেড়ে গেছে বুঝলি, সচেতন হওয়াই ভাল। তো খেয়ে টেয়ে ঘুমো। তুর্য, দৃর্বত্ত মানে বোঝ? এরা দেখতে মানুষের মত, কিন্তু মানুষমানবতাশব্দের জন্য মারাতœক হুমকি।
শাহাব চাচার ভয় করলেও তুর্যর অতটা করেনি। লোকটার সবকিছুতেই উদ্বেগ। ছোটকাল থেকে এমনই দেখে আসছে সে। শাহাব চাচা অভিভাবক হলেও বয়সে কাছাকাছি হওয়ায় তাদের ফ্রেন্ডশিপ আছে। বিয়ে করে চাচা একটু বদলে গেছে। বিয়ের আগের দিন বললো, ‘তুর্য শোন, তোর সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক থাকবে কিন্তু যখন তোর চাচীর সামনে থাকবো, তখন চাচা চাচা ভাব নেব, মানিয়ে নিস।শুনে হাসি পেল তুর্যর। সাহাবচা সিগারেট জ্বালালেন। দেখ ছেলে, প্রফেসর মানুষ। তাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। এমনিতে বয়সে তরুন, ভাবে একটু ভারস্থ না হলে চলে, বল?’
তুর্য বললো, ঠিক আছে। দেখছি, কিন্তু চাচা, তোমার শালীকে আমার মনে ধরেছে, তুমি চাচা হওয়ায় আমি হতাশ, এ ক্ষেত্রে কি করবে?’ অভিভাবকের সুর নিয়ে সাহাব চাচা বললেন, ‘ অন্য কাউকে খুঁজে বের কর, তোর একুশ হলেই বিয়ে দিয়ে দেব।
হেসে উঠলো তুর্য। ওহ মাই গড! এভাবে পা দিচ্ছি না চা’, তুমি তোমার পথ দেখ।
সাহাব চাবললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর ভয় করছে?’
ভয় বলছো কেন, তাতে আমার সুবিধেই হয়! গবেষণার ক্ষেত্রও বাড়বে।তুর্য বললো।
শাহাব চাচা চোখ ছোট করে বললেন, ‘সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাস নাকি?’
চাইলে দেবে?’
ভেবে দেখবো, তোর ডালিংগুলোর খবর বল
ডালিংগুলো?’
বাসে ঝাকুনিতে ভাবনা থেকে সরে এলো তুর্য। যাত্রীদের মধ্যে মুখচাওয়া চাওয়ি। জিজ্ঞাসার কথাবার্তা। ইতোমধ্যে হরতালের খবর রাষ্ট্র হয়েছে। সেটা বাসের ভেতরও পৌঁছে গেছে। তুর্য অন্যদের আতঙ্ক দেখতে দেখতে মনে করার চেষ্টা করলো, চাচা আর কি বলেছিল? ডালিংগুলোশব্দটায় তুর্যও কি একটা বলেছিল। সবকিছু এতো দ্রুত বিস্মৃত হয় কেন? ও বিষয়ে আর কিছু মনে পরছে না। একটা শব্দ মনে পড়ছে, ‘ঝামেলা’, তুর্য বলেছিল, ঝামেলাই আছি।সত্যিই সে ঝামেলায় আছে। মনে হচ্ছে আজকের ঢাকা শহর তার জন্য অমঙ্গল শহর। এর মধ্যে মনে উকি দিয়ে গেল, এসএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ায় সাহাবচাতাকে গিফট হিসেবে সিনেমা দেখিয়েছিল। এক টিকিটে দুই ছবি।চাচার ধারণা, ‘তাড়না না থাকলে, সাফল্য সহজ হয় না।
টঙ্গি মোড়ে আকাশ ফর্শা হয়ে এলো। ট্রায়ারে আগুন জ্বলছে। আগুন নেভানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। শিশির ভেজা সড়কে পায়ের ছাপ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের টুকরো দেখে বোঝা যায়, এখানে কিছু একটা হয়েছে। ডান সাইট দিয়ে তড়িৎ বেগে মোড় ঘুরলো বাস। মুহূর্ত্বে তুর্যদের গাড়ির ছাদ পেড়িয়ে গাজিপুর রোডে পরপর তিনটে ককটেলের বিস্ফোরণ। তুর্য জানালা দিয়ে প্রথম দেখলো, আরেকটি অদ্ভুত! হাতের কব্জি থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে এসে ওর জানালার নিচে লাফালাফি করেছে স্তুপ স্তুপ বিভৎস মাংস। দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলা বাস থেকে আর্তনাদের শব্দ শোনা গেলেও মুখগুলো দেখা গেল না। কাঁচা ধোয়া সব ঢেকে দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরেকটি বাস ধোয়া পেরিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। আরেকটি আর্তনাদের শব্দ শোনা গেল। তখনো ছটা বাজেনি। বাসের মধ্যে কান্নাকাটি, হুল্লোর শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন নামিয়ে দিতে। তারা আর রিস্ক নিতে রাজি নয়। বেশিরভাগ বলছে, দেশেশুনে সামনে এগুবার। এতোদুর থামলে দুর্গতির অন্ত থাকবে না। বিমানবন্দর এলাকায় এসে রাস্তায় পুলিশের দেখা পাওয়া গেল।
বাস থামিয়ে দিয়ে এবার হরতাল কার্যকর করলো পুলিশ। সামনে আর যাওয়া যাবে না। তারা জানালো, ‘ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে।বাস থেকে নেমে তুর্য অবাক। আশেপাশে কোন গাড়ি নেই। মানুষ নেই বললেই চলে। থমথমে পরিস্থিতি। ওদের বাস এতোদুর এলো কি করে, ‘সাহসী চালক’, বলে চালককে দেখে নেবার চেষ্টা করছে সে।
আতঙ্কগ্রস্থ মানুষগুলো কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। সাথে কোন কোন বাচ্চাও। সামনের দিকে হাটতে শুরু করলো কেউ কেউ। তুর্যও। কিন্তু একি অবস্থা, আগে পিছের শব্দে পা যেন আর ওঠে না! চেয়ারম্যান বাড়ি এসে মনে হলো আমার নিজস্ব দুটি পা মাটির উপর পড়ছে না। পা পড়ছে আতঙ্কের উপর। ফ্লাইওভারের নিচে মাঝখানটা থেকে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। কখনো একটা, কখনো অনেকগুলো একসাথে। সেই সাথে পুলিশের সাইরেন। গতিরপা দুটি রাস্তায় রেখে ফুটপাতে বসে পড়লো তুর্য। দৌঁড়াতে থাকা এক বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বললো, ‘এই ছেলে বোকার মত বসে পড়লে কেন, দৌঁড়াও, দৌঁড়াও। হরতাল শুরুর আগেই তিনজন গেছে। দৌঁড়াও দৌঁড়াও।দৌঁড়ে চললো বৃদ্ধ। গুলির শব্দ এগিয়ে আসছে। শব্দের আগে দৌঁড়ে আসছে আরো কয়েক জন যুবক। এদেরই কেউ কেউ আবার পেছনে এগিয়ে গিয়ে ককটেল ছুড়ছে। দ্রিম করে কেঁপে উঠছে এলাকা। ততক্ষণে তুর্য দৌঁড়ে বৃদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে। পর্যটন কর্পোরেশনের সামনে আরেকটা জটলা। এখানে পুলিশ নেই। বিশাল দুটো ট্রায়ারের উপর পেট্রোল ঢালা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে মারলো। সেকেন্ডের মধ্যে আগুনের কুন্ডলী তৈরী হলো। তুর্য থেমে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগেই। বৃদ্ধটি এ পর্যন্ত এসে দাড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘বলো তো, এসব কি তান্ডব শুরু হলো? এরা পেয়েছে টা কি?’ খুব ক্লান্ত হলেও বৃদ্ধের চোখ থেকে থোকথোক আক্রোশ বেড়িয়ে আসছে। তুর্য দেখার চেষ্টা করলো, বৃদ্ধের চোখ লাল কি না? না। তার চোখ লাল নয়। বাচ্চাদের মত সবুজ। ঠিক সবুজও নয়। বাদামী। এতক্ষণে সে লক্ষ্য করলো, বৃদ্ধের গায়ের রং রেড ইন্ডিয়ানদের মত, চোখ বাদামী। এ চোখ আক্রোশে লাল হলেও সে লাল বোঝা মুশকিল। অনেকক্ষণ দৌঁড়ে এসে চিৎকার করায় তার বাদামী চোখে পানি চলে এসেছে। কণ্ঠের তেজও বলে দিচ্ছে সে অসহায় হয়ে পড়েছে। তুর্যের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ আবার চেচিয়ে উঠলেন, ‘এরা পেয়েছে টা কি?’ তুর্য মাথা নিচু করলো।
বিকট হর্ণ বাজিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসছে। সামনে পুলিশের রায়ট কার। তিন চারটে গুলি ছুড়তেই পিকেটাররা দৌঁড়ে পালালো।
বৃদ্ধ বললেন, ‘এবার চলো।
ট্রাভেল ব্যাগ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গ্রাম থেকে আসলে না কি, কোথায় যাবে?’
তুর্য বললো, ‘বাংলামোটর।
বৃদ্ধ ধাপ নামিয়ে নিলেন। তুমি যাবে কি করে?’
তুর্য বললো, ‘জানি না।
আমতলি থেকে গুলি শুরু হয়েছে। এগলি ওগলি থেকে হুটহাট বেড়িয়ে আসছে ককটেল। এখানকার পুলিশ ফায়ারিং মুডে অবস্থান নিচ্ছে।  বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার সাথে এসো
তিতুমীর কলেজ পার হয়ে এসে একটা রিকশা পাওয়া গেল। গুলশান মোড়ে ট্রায়ারে পানি ঢালছে পুলিশ। পূর্ব দিকে শখানেক লোককে সামাল দিচ্ছে ডজন খানেক পুলিশ। কাদুনে গ্যাসের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আরো জোরে পা চালাও। আতঙ্ক ও অভিজ্ঞতায় রিকশাওয়ালা শরীরের সবটুকু শক্তি প্রতি সেকেন্ডে ঢেলে দিতে থাকলো পেডেলে। এগারটা সাতাশ মিনিটে মধ্য বাড্ডার একটা গলির সামনে রিকশা থামলো। এদিকের অবস্থা একটু ঠান্ডা। বৃদ্ধও ঠান্ডা হলেন। ট্রাউজারের পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে জ্বালালেন। তুমি সিগারেট টানো?’ তুর্য বললো, ‘হাঁ, টানি। বৃদ্ধ আরেকটি সিগারেট বের করতে গেলে তুর্য বললো, ‘কিন্তু আপনার সামনে টানবো না।
বৃদ্ধ বললেন, ‘লজ্জা পাবার কারন নাই। যে ধকল গেল। টানো, টানো।তিনি সিগারেট এগিয়ে দিলেন। তুর্য বললো, ‘ঝামেলা থেকে বাঁচালেন, সিগারেট না টেনে তার রিওয়ার্ড দিলাম। আর দেখা নাও হতে পারো। পরে সুযোগ পাবো না।
বৃদ্ধ কাঁধ ঝোকালেন। হুম্, বুঝেছি’, তো তুমি এখানে কি করো?’ ‘পড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফিজিক্স। বাড়ি কোথায়?’ ‘রংপুর।’ ‘রংপুর? তুমি রংপুরের ছেলে? বলো তো, আগে বলবা না? সতের বছর রংপুরে কাটিয়েছি বুঝলে।
ফোন বেজে ওঠে বৃদ্ধের। রিসিভ করেই বলেন,‘ হ্যাঁ রে, অল্পের জন্য বেঁচে আসলাম। হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাল আছি, চলে এসেছি, গলির মোড়ে। না, না, এখানে নয়, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে। হ্যাঁ, দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে, সে কি অবস্থা। এখনো হাপাচ্ছি বুঝলি। না, না, আমি ভাল আছি, গায়ে লাগেনি, দুহাত দুরে পরেছিল। বড় বোমা নয়, ককটেল জাতীয় কিছু। না, কিন্তু আমি বোধহয় কানে একটু কম শুনছি না রে?’
কানে কম শুনছো কি না, নিজে বোঝার চেষ্টা করো, একদম দেরি করো না, এখনি চলে আসো।তুর্য হাসছিল। ফোন রেখেই তাড়াহুরো শুরু করলেন বৃদ্ধ।
বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি দেখেশুনে যাবার চেষ্টা করো বাবা, আমি যাই, ভালো থেকো।তুর্য বললো, ‘আপনিও ভাল থাকবেন। এই বয়সে হরতালের মধ্যে রাস্তায় বেরুবেন না।
বৃদ্ধ আরো এক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘হাসপাতালে ছিলাম বাবা, একদম বুঝিনি। এরা সবাই শুয়োরের বাচ্চাবুঝলে, একদম পায়ের কাছে পড়েছে, রিকশা থেকে লাফ না দিলে মারা পড়তাম। বেঁচে আসলাম বাবা। এখন কানে বোধহয় কম শুনছি। তুমি যাও, দেখেশুনে যাও।
আরেকটি রিকশার খোঁজে মিনিট চারেক হাটার পর একটা মিছিলের মুখোমুখি হলো তুর্য। ভাংচুর করার মত কোন গাড়ি না পেয়ে রাস্তার পাশের দোকানপাটে লাঠির আঘাত, লাথি-ঘুষি যে যা পারছে মারছে। একজন আগুন লাগাবার চেষ্টা করছে গলির মুখে ঢেকে রাখা অটো সিএনজিতে। কোত্থেকে তিনচারটে পুলিশের গাড়ি এলো। গাড়িগুলো তুর্যকে অতিক্রম করেই গুলি শুরু করলো। জলকামান স্টার্ট করে দমকলের একটি গাড়ি সামনে দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বৃষ্টির মতো ককটেল বিস্ফোরণ শুরু হলো। এইটুকু বুঝেই পেছনের দিকে দৌঁড় দিলো তুর্য। সেই গলির মুখে যেতেই তুর্য দেখলো, বৃদ্ধও দৌঁড়ে এগিয়ে আসছেন। তুর্যর মুখোমুখি হতেই হাত ধরে বললেন, ‘এসো
তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটা মেয়ে গেট খুলে দিলো। ওকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হবার পরামর্শ দিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। পকেটা হাতড়িয়ে ফোন বন্ধ পেল সে। সাহাব চার মুখ মনে পড়লো। লোকটি কিনা চিন্তা করছে। চার্জে লাগিয়ে ফোন করলো তুর্য। ভাল আছিস কিনা, তুর্যকে জিজ্ঞেস করেই শোকগ্রস্থ কণ্ঠে সাহাব চাচা আক্রোশে ফেটে পড়লেন। একদম বোকা ছেলে তুই। একদম বোকা। তোর জন্য আমার কত চিন্তা, এসব বুঝিস? এমনি এমনি বড়ো হয়েছিস না?’
তুর্য বললো, ‘মামা, এতো চিন্তা করার কিছু নেই। ঘুম থেকে জাগতে পারিনি, ফোনে চার্জ ছিল না। ঘটনা শেষ। আমি এখন হোটেলের বেলকনিতে। চিন্তা করো না মামা। আচ্ছা মামা, আমার মামি, মানে তোমার বউও কি আমার জন্য এমন চিন্তা করে?’
চাচা বললেন,‘ না রে, এমনি তুই কাছে থাকলে দরদ বেশি দেখায়। কিছু মনে করিস না, হ্যাঁ! আমি তোকে অনেক ভালবাসি চ্যাপ্টা, তোর আর কার ভালবাসা দরকার বল? তারচেয়ে তুই প্রেম কর, প্রচুর প্রেম কর।এখন আমি খাবো, রাখছি বলে ফোন রাখলো তুর্য। খেয়াল করে দেখে সে হাসছে। চাচা ওকে বছর দুয়েক পর চ্যাপ্টা বলেছে, সে বলেছে মামা। ছোলবেলা থেকেই দুজন দুজনকে ইমপ্রেস করার ক্ষেত্রে বিকল্প নাম ব্যবহার করে। হাসি জোড়ালো হয় তুর্যর, তাই বলে চ্যাপ্টা’?
মেয়েটি এসে জিজ্ঞেস করে, ‘ফ্রেস হয়েছেন আপনি? বাবা ডাকছে, খাবে।
তুর্য বলে, ‘না হইনি, এই হয়ে নিচ্ছি। বাবাকে বলো, আসছি।ব্যাগ খুলতে খুলতে তুর্য জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কি? আমার নাম তুর্য।’ ‘সুস্মিতা’, বলে চলে যাচ্ছিলো সুস্মিতা। তুর্য ডাকলো, ‘শোন, একটু হাসো তো।
উদ্বেগের কিছু নাই, আমার হাসি এমনিতেই সুন্দর। সবাই বলে। আপনিও বলবেন। কিন্তু এখন হাসতে পারছি না, অল্পের জন্য বাবা বেঁচে আসছে, তার পায়ের কাছে ককটেল পড়েছিল। শয়তানদের কর্মকান্ড দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে কেঁদে ফেলি। কাঁদবো? আমি কাঁদলেও সুন্দর লাগে। সবাই বলে। আপনিও বলবেন।
হেসে ফেললো তুর্য। মনেমনে আশ্চর্য মেয়েবললো।
সুস্মিতা বললো, ‘আপনি বাবার কে হোন?’
সহগাজী। মানে মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজি এই সূত্রে।
ঠোট বাঁকিয়ে, কাঁধ ঝাকিয়ে কোন কিছু বোঝেনি ভাব করে চলে গেল মেয়েটি। তুর্য বাথরুমে ঢুকবে এ অবস্থায় ফোন বেজে উঠলো। পাপুল। সে উৎকণ্টা ও আক্রোশ একসাথে জড়িয়ে বললো, ‘সিরাজুল ভাই তোকে খুঁজে অস্থির। এই সময়ে ফোন বন্ধ করে বসে আছিস না? আরে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা পরম ধর্ম বুঝলি।
তুর্য ঠান্ডা স্বরে জানতে চাইলো, ‘কি ঘটনা?’
খেকিয়ে উঠলো পাপুল, ‘পার্টি হরতাল দিছে। পার্টি মনে করেছিল লাখ লাখ লোক রাস্তায় নামবে। দেখা গেল শ’, হাজার হাজার। খালি গাড়ি ভাংলে আর আগুন লাগালে হবে না, রাস্তায় লোক লাগবে। উপড় থেকে অর্ডার আসছে, সিরাজুল ভাই বলেছে তোকে রাস্তায় নামতে।
চমকে উঠলো তুর্য। বলে কি ছেলে! সে জোর দিয়ে বললো, ‘কিন্তু আমি তোদের দলের সদস্য নই।
এবার ঠান্ডা মাথায় শুরু করলো পাপুল। মুসলমানদের ইমান রক্ষা মহান দায়িত্ব, একজন ইমানদার ব্যক্তিকে কুচক্রিদের অপঘাত থেকে রক্ষা করতে যে যুবক শহীদ হবে হাসরের ময়দানে সে বেহস্তে যাবার মিছিলে নেতৃত্ব দেবে! দোস্ত কি রায় হয়েছে তুই জানিস, এই মুহুর্ত্বে রাস্তায় না নামলে তোর ইমান থাকবে না। আমার ইমান থাকবে না। তাছাড়া সিরাজুল ভাই তোকে সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই দাবীতে সে তোকে বন্ধু হিসেবে চাইছে। পিকেটিং করতে হবে না, সাথে থাকলেই চলবে। না গেলে কিন্তু ভাই রাগ করবে।
তুর্য বললো, ‘ পাপুল ঠান্ডা হ, এক মিনিট আমি বলি তুই শোন, বুঝতে পারবি। প্রথমত আমিও একজন ইমানদার ব্যক্তি, দেশের যা খবর শুনছি তাতে নিজেকে দুর্বত্তদের হাত থেকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। কর্তব্য ফরজে আইন, দায়িত্ব ফরজে কেফায়া। দেখ রাস্তায় নামা, না নামার ইচ্ছা টোটালি আমার। তাছাড়া আমি ঢাকা নেই। জানিস তো, আমি গ্রামের বাড়ি এসেছিলাম। কালকেই যাবার কথা ছিল, কিন্তু রায়ের খবরে বাস লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আলীগ নেতার বাসে আসছিলাম, টাঙ্গাইল এসে আটকা পড়েছি। হোটেলে উঠেছি। সিরাজুল ভাইকে বলিস আমি ঢাকা গিয়ে দেখা করবো। ভাই তোর কাছে থাকলে ফোন দেকথা বলি।
পাপুল বললো, ভাই সাংগঠনিক কাজে ময়মনসিংহ আটকা পড়েছে। আচ্ছা, তোর হোটেলের নাম বল।তুর্যর মনে হলো, সিরাজুল ভাই বলেছিলেন, বিয়ে না করলেও তিনি স্বামী, তার শ্বশুরবাড়ি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায়। প্রয়োজনে তিনি প্রেম করবার পরামর্শ দিয়েছেন। হেল্প লাগলে বলতেও বলেছেন। হোটেলের নাম কি তুর্য?’, পাপুল আবার বললো। তুর্য বললো, ‘মধুরিমা
বাই বলে স্বস্থি পেল সে। একটি এসএমএস এসেছে। বিকাশে টাকা। তিন হাজার। তিন হাজার টাকা দেখে মন চলমলিয়ে উঠলো। পুরোটাই লাভ। সেই সাথে কিছু শব্দ মাথার মধ্যে খেলা করে যাচ্ছে, যা এখনি ফোনালাপে বলাবলি হয়েছে। যেমন একটি তার দুর্বৃত্ত। এ শব্দের সাথে সাহাব চার মুখ মনে পড়লো। রাতের সে বলছিল। এবার বাথরুমের দরজা খুললো তুর্য। ভেতরে যাওয়া হলো না, পাপুলের ফোন।
স্যরি দোস্ত, টাঙ্গাইলে এই নামের কোন হোটেল নেই। বেইমানী করলি না’, ভাইকে বলছি, মনে কর এই এলাকা তোর জন্য নিষিদ্ধ হলো।ফোন রেখে দিলো সে।
ওহ মাই গড!’, বলে বসে পড়লো তুর্য। এ কি অবস্থা? তাকে মেসে যেতেই হবে। কাপড়চোপড়ের জন্য না হলেও, কাগজগুলোর জন্য।
ছয় বছর আগে, ফার্স্ট ইয়ারে, বিদেশী এক সায়েন্স ফিকশনে আটকে যায় তুর্য। তার ধারণা, এই ফিকশনকে সে বাস্তবে দাঁড় করাতে পারবে। আলো নিয়ে গবেষণা শুরু করে সে। প্রতি বছর এগুতে থাকে সূর্যরশ্মিকে আটকে শক্তি সঞ্চয় করার কাজে। এই সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ঘটিত যাবতীয় কাজ করা যাবে। তাতে বর্তমানের সোলার সিস্টেমের দশ ভাগের একভাগ খরচা হবে। ছয় বছর ধরে থিওরি ও প্রাকটিক্যালে এগিয়েছে তুর্য। ওর বয়সী চাচার এই গর্বে ওকে নিয়ে যত উদ্বেগ। শাহাব চার কথা ভাবতেই দায়িত্ববান হয়ে ওঠে তুর্য। সেই দশ বছর বয়সে বাবাকেও হারালে সমসাময়িক চাচা ওকে এতোদুর নিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শাহাব চাচা, ইউ আর গ্রেট’, মনে মনে বলে সে।
সুস্মিতা আসে আবার, ‘আপনার এখনো হয়নি? সারাদিন এতো প্রেম করা লাগবে কেন? সারাদিন কানে ফোন লাগিয়ে থাকা ছেলেদের আমি দেখতে পারি না। আমার চেয়ে বড়দেরও না।সুস্মিতা চলে গেল।
ফোন অফ করলো তুর্য। ঝামেলা আর ভাললাগছে না। তাকে ফ্রেশ হতে হবে। খেতে হবে। বৃদ্ধ অপেক্ষা করছেন। বৃদ্ধ শব্দটায় অস্বস্থি হচ্ছে। ভদ্রবৃদ্ধের নাম কি? জেনে নেয়া যাবে। আপাতত তিনি সুস্মিতার বাবা। বাথরুমে ঢুকলো সে।
বিকেলে আবার এসেছিল মেয়েটি। বাবা বলেছেন, সারাদিন ঘরে বসে থাকার দরকার নেই। বাইরে যাওয়া যাবে না, তবে ছাদে যাওয়া যেতে পারে।তুর্য বললো, ‘যাবো, তুমি গেলে।সুস্মিতা বললো, ‘যাব, গান শুনালে।তুর্য বললো, না, আমি গান টান পারি না, চলো তোমাকে যাদু দেখাবো।’ ‘উফ!বলে লাফিয়ে উঠলো সুস্মিতা, দুহাত উপড়ে তুলে নাচের ভঙ্গিতে দুলছে সে। তুর্যর হাসি পেল। একবার মনে হলো, বলি, ‘এই পিচ্চি, নাচবে তুমি, কেবল আমার সামনে? আমি হাছন রাজা হয়ে বসে থাকবো, আর তুমি পেয়ারী হয়ে গাইবে, ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকাদুনয়নে নেশা লাগিল রে..’, কিন্তু তুমি যে পিচ্চি! তাতে কি, এই পিচ্চি, নাচবে তুমি? এই সুস্মিতা?’ তুর্য অবাক হয়। এ সব কি ভাবছি। হাইস্কুলের আরেক পিচ্চি মস্তিষ্কে ঘুরে যায়। আমার কি অতটা ভালবাসা দরকার? তাহলে প্রমিকে বলছি না কেন, ও তো বলেছে, ‘সব দেবে। ভালবাসার জন্য যতোটা প্রয়োজন।ভালবাসার জন্য কতটা প্রয়োজন ভেবে তুর্যর মন আনচান করে ওঠে। আবার সুযোগ হলে সেই মন ধরে হাছন রাজা টান মারেন। তখন মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে দুলতে থাকা সুস্মিতা, অন্যান্য পিচ্চি ও উর্ধ্বোতনরা । 
প্রমির কথা মনে হয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়। আত্মঘাতি মেয়ে। ঢাকা এসেছি, ওকে ফোন দিইনি, কোনভাবে জানতে পারলে তুলকালাম ঘটিয়ে দেবে। ওকে ফোন দেয়া দরকার। ফোন কোথায়? আবার অবাক হয় তুর্য, কখন নাচ থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আছে সুস্মিতা। তুর্য বলে ওঠে, ‘ওহ, তোমাকে যাদু দেখাতে হবে তাই তো? চলো, ছাদে চলো।প্রমিকে ফোন করা হয় না। এই টুকু মেয়ে একবার বলেছে, ‘এতো প্রেম করা লাগবে কেন?’ যাবার আগে ব্যাগ থেকে তিন বক্স কাঁচের টুকরো নিলো সে। সুস্মিতার থেকে জোগার করে নিলো বাটাম, কাট, কাঠি, সুতো। ছাদে সুস্মিতার প্রিয় জায়গা দেখে নিলো। তারপর সুস্মিতাকে আধা ঘণ্টার জন্য ছাদ থেকে নামিয়ে দিলো। যাবার আগে বললো, ‘হাফ ঘণ্টা পর এসে তুমি অদ্ভুত কিছু দেখবে, অতএব গিফট হিসেবে আমার জন্য লাইট লিগারের একটা দুধচা বানিয়ে নিয়ে এসো। নিজে বানাবে। যাও, যাও।’ ‘আচ্ছা’, বলে নাচের ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে চোখমুখ ভর্তি উচ্ছাস নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো সুস্মিতা। পেছনের পকেট থেকে বের করে ভাঁজ হওয়া সিগারেটটি নেড়েচেড়ে জ্বালিয়ে নিলো তুর্য। তারপর শুরু করলো কাঠামো তৈরীর কাজ। রাস্তায় বোমাবাজির ধোঁয়া বিষ ছড়ালেও সুস্মিতাদের ছাদে আজকের আকাশ তরতাজা পরিস্কার। এখনো রোদের তেজস্ব কুয়াশা গ্রাস করতে পারেনি। ইতোমধ্যে উত্তরের কোনায় ঢু মেরে ক্যারম বোর্ডে দুটো গুটি ফেলে এলো তুর্য।
এতো অপেক্ষার পর ছাদে ফিরে হতাশ সুস্মিতা। কিছুই হয়নি। গ্রাম্য মেলায় এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটানোর খেলা হয়, বেলুনের জায়গায় কতগুলো কাঁচ বসিয়ে একটা কাঠের কাঠামো তৈরী করে নিয়ে বসে আছে তুর্য। সুস্মিতার থেকে চা নিয়ে আবারো একটা সিগারেট জ্বালালো সে। সুস্মিতা কাচগুলো ভাল করে লক্ষ্য করছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোন অদ্ভুত কিছুআছে। এলোমেলো সাজানো কাঁচ ছাড়া কিছু পাচ্ছে না সে। তুর্য বললো, ‘যাও, এবার এয়ারগান নিয়ে এসো।সুস্মিতার মন খারাপ, ‘আমাদের বাড়িতে এয়ারগান নাই।কিছুক্ষন থেমে বললো, ‘তাহলে অদ্ভুত কিছু হবে না?’
অদ্ভুত কিছু হলে তুমি কতটুকু খুশি হবে?’
চা খাওয়ানোর সমান।
ওকে। ডান। লেটস গো।
সুস্মিতাকে কাঠামোর পেছনে নিয়ে সামনের দিকে আটকে রাখা পর্দা সরিয়ে নিলো তুর্য। বললো, চলো উত্তরে যাই, মঙ্গা দেখে আসি। সুস্মিতা কিছু না বুঝে পিছু নিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটি নিস্তব্ধ বিকেল দেখা গেল। নিস্তব্ধ এই অর্থে, এই আকাশ বড়ই পরিস্কার ও নীলচে। যে বাতাসগুলো বয়ে যাচ্ছে এখান দিয়ে তার সবগুলোয় উর্বষী, হিমেল। গাছগুলোতে পাখির কলরব একদম নেই। নিচের গলি, মার্কেট, পানের দোকান জনহীন। মধ্যবাড্ডার এই উঁচু কাঠামো গুলো অট্টালিকার পরিবর্তে আজ নির্জন মঠে পরিনত হয়েছে। কেবল কিছু শব্দ আছে। শব্দগুলো গুলি ও ককটেলের। হয়তো গন্ধ ও ধোঁয়াও আছে, নাগালে না থাকায় আমি অনুভূতিতে পাচ্ছি না। অনুভূতিতে পাচ্ছি কোমল অনুষঙ্গ, সদ্য বালিকা ও তার শরীরের গন্ধ।
সুস্মিতাকে অপরদিকে দাঁড় করিয়ে ক্যারম বোর্ড সাজাতে লাগলো তুর্য।
আমাকে নাচ দেখাবে সুস্মিতা, একা?’
আমার নাচ কেন দেখতে চান?’
তোমাকে দেখতে চাই।
আমাকে কেন?’
তোমার বয়সী একজনের প্রেমে আমি প্রথম পড়েছিলাম ও ডুবে গিয়েছিলাম। আমি এখন বুঝতে পারি না, ঐ টুকুন মেয়ের মধ্যে কি ছিল, যাতে ডুবে গিয়েছিলাম। তুমি মাত্র একবার সুযোগ দিলে বুঝতে পারবো।
স্যরি, নাচতে পারছি না। আমি খুবই চালাক মেয়ে। বাবার চেয়েও।
তার স্কোর কত?’
জানি না
তোমার?’
জানি না।
খেলা চলছে গতিবিহীন। সাদা কালোর কোন বালায় নাই। তুর্য আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। এ সিগারেটের ধোঁয়া শক্ত গন্ধের জানাল সুস্মিতা। তুর্য হেসে পাড়ি দিলো। ফোনের সঙ্গে তার সব বন্ধ এখন, হাসন রাজা তার মাথায় বেশি আসা যাওয়া করছে। সামনে তাকিয়ে প্রতি দৃষ্টিতেই সুস্মিতার মধ্যে নতুন কিছু দেখছে আরও নতুন কিছু দেখার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে গুলি ও ককটেলের শব্দ ভালো লাগতে শুরু করেছে। তুর্যর দৃষ্টিতে এখন আবিস্কার ও মস্তিষ্কে আরো কিছু শব্দঘটিত শব্দের আসা যাওয়া। গুলি ও ককটেলের শব্দের পরিবর্তে আয়ুববাচ্চুর গিটার হলে বেশি ভাল হতো, মনে হলো আরেকজন নেচে গেলে বেশি ভাল হতো। মনে পড়লো দীপিকা পাডুকনের মুখ ও অন্যান্য অবয়ব। 
আজকের মত মাথা ব্যাথা শুরু হতে শুরু করেছে। এ অবস্থা কতদুর গিয়ে ঠেকবে বুঝতে পারছে না তুর্য। মস্কিষ্কের কিছু কোষ গাজিপুর মোড়ের বিচ্ছিন্ন আঙ্গুলের লাফালাফি, চেয়ারম্যান বাড়ির আতঙ্ক ও পাপুলের বাণী মেনে নিতে পারছে না।এ বিষয়াবলী নতুন। সুতরাং ব্যথা অসম্ভাব্য।
তোমার আইকিউ স্কোর মেপে দিতে পারি।তুর্য বললো।
সত্যি!ঝলমলিয়ে উঠলো সুস্মিতা। মনে মনে নাচতে রাজি হলো। কিন্তু আজ তার পক্ষে নাচা সম্ভব নয়। আজ তার মন খারাপ, বাবা অল্পের জন্য বেঁচে এসেছেন।
তুর্য বললো, ‘তবে যদি তুমি নাচ দেখাও।
ঠিক আছে, নাচছি না, তবে আমিও আপনাকে চমকে দেব।
ডান। প্রথমে আমি চমকে দিই, চলো।
ফিরে কাঠামোর সামনে পর্দা টানিয়ে দিলো তুর্য। সুস্মিতার হাত ধরে দেয়ালের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলো, সেখানে প্লাস্টার পুড়ে কালো দাগ হয়ে লিখা রয়েছে সুমিতা। বাতাসে সুতো ছিড়ে যাওয়া একটি এসর কাছে সুস্মিতার বেড়াল ছানা ব্যায়াম করা শুরু করেছে। সুস্মিতা আনন্দে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে থেকে গেল। এখন লাফালে চলবে না, দেখতে হবে। সে দেখলো একবার তুর্যকে, একবার দেয়ালের সুমিতাকে। তার চোখমুখ দিয়ে বিস্ফোরিত হচ্ছে উচ্ছ্বাস ও আতঙ্ক ।
সে তার সব আদর গলায় জড়িয়ে কান্নাকান্œা স্বরে বললো, ‘ইস, আরেকটি এস খসে না গেলে সুস্মিতাহতো। সে এক নতুন বিকেলের মুখোমুখি যেটি সন্ধ্যা হতে চলেছে। তুর্য একবার হাতজোড় করে স্যরি বলেছে। একটা ঘোর সুস্মিতাকে গ্রাস করেছে আর সে ইতোমধ্যে ভুলে গেছে আজ তার মত খারাপ, অল্পের জন্য বাবা বেঁচে গেছে।
তুর্যর মনে হলো একটা উপন্যাসের কথা। বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে কি আরেক ফাল্গুন, জহীর রায়হানের কোন একটা। ছাদে কে যেন কাকে প্রথম চুমু দিয়েছিল। তাতে যেন কার বুকে ঝড় উঠেছিল। সুস্মিতাকে চুমু দিলে কি এখন এখানে বরফ গলা নদী তৈরী হবে? আলোর শক্তি দেখে দারুন মুগ্ধ সুস্মিতা। আনন্দে কথা বলতে পারছে না। তার ইচ্ছে করছে নাচতে। কিন্তু নাচতেও পারছে না। এর আগে একবার নাচতে গিয়ে দেখে, তার বাবার বন্ধু লোকটা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তার এখন কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। এখনো একবার তুর্যর দিকে তাকাচ্ছে, একবার দেয়াল পোড়া সুমিতার দিকে। তুর্যও কিছু বলছে না। ঠোটে সিগারেট নিয়ে দিয়াশলাই খুলতে লাগলো সে। মুখভর্তি কাঁপাকাঁপা রাগ নিয়ে হুট করে সুস্মিতা বললো, ‘শুনুন..। তুর্য সিগারেট জ্বালালো। থেমে গেল সুস্মিতা। তার মনে হয়েছিল, একটা লোক এতো সিগারেট খাবে কেন, তাকে শাসিয়ে দেয়া দরকার। পরবর্তীতে তার মনে হলো, না খাক, এই লোকটা হয়তো  বিজ্ঞানী। তুর্য বললো, ‘বলো।
সিগারেট টানছেন?’
হুম, তুমি টানবে?’
না, আমি সিগারেট টানি না।একটু থেকে আবার বললো, ‘কি সিগারেট?’
গোল্ডলিফ
ভাল সিগারেট?’
না, কোন সিগারেটই ভাল নয়। যাদু ভাল লেগেছে তোমার?’
সচকিত হলো সুস্মিতা। হ্যাঁ, খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু আমার ভাললাগা বুঝাতে পারছি না।
কেন?’
সত্যি বলতে আমি আনন্দ পেলে নেচে উঠি। কিন্তু আপনার সামনে আর নাচতে পারছি না।
কেন?’
আপনি বিজ্ঞানী, তাই।
ধেৎ মেয়ে, যাদু দেখালাম, তোমার ইচ্ছে করলে নাচতে পারো!সাহাব চার কথা মনে পড়লো, তার ধারণা, ‘তাড়না না থাকলে সাফল্য সহজ হয় না।সুস্মিতা নামক সদ্য বালিকাটির হাসি, মুগ্ধতা, গন্ধে সে কি তাড়নার সংস্পর্শ পেয়েছে, বুঝতে পারছে না। হাসন রাজা তুর্যের তাড়নার নাম নয়, আহ্লাদের।
সুস্মিতা বললো, ‘ঠিকআছে, আমিও আপনাকে যাদু দেখাবো। আপনার যাদু সৃষ্টির জন্য তাই সাথে গিফট এক কাপ চা। আমি বানাবো। কিন্তু আমার যাদু ধ্বংসের যাদু, তাই আমার গিফট লাগবে না।সুস্মিতা দৌড়ে সিড়ির দিকে গেল। স্কার্ট পরায় তাকে আর পিচ্চি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে উড়ে যাচ্ছে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি, মনে হচ্ছে বাতাসে দুলছে ভেসে ওঠা পদ্ম, যার শরীরময় প্রতি সেকেন্ড জমা হচ্ছে গাম, গন্ধ। 
মিনিট পাচেকের মধ্যে চা আর ক্যামেরা নিয়ে এলো সুস্মিতা। ওর ছবি তোলার হাত ভাল বলে অনেকগুলো ছবি তুললো তুর্যর। বিভিন্ন মুডে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আজ আর যাদু দেখানোর সময় নেই, কাল। (লেখা চলছে)